উপরওয়ালা কিন্তু সব দেখছে! নিখুঁত ভাবে। এবং নিঃশব্দে।
তার স্মৃতি প্রখর। সে সব ধরে রাখে। এবং ধরিয়ে দেয়।
অতএব, সাধু সাবধান!
‘ধুস, আমি উপরওয়ালা-টোয়ালা মানি না!’, কেউ বলতেই পারেন! তবে সে কিন্তু আপনাকে আপাদমস্তক মাপছে। এবং গুনে গুনে হিসেব রাখছে কোন ব্যাটে কত রান!
বছর কয়েক আগেও বহু দোকানে লেখা থাকত, ‘ক্রেতাই ভগবান’। আর ঠিক তার পাশেই লাল কালিতে জ্বলজ্বল করত, ‘ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’।
এখন সে সব লাজ-লজ্জা ভুলে পকেটে শোভা পায় ক্রেডিট কার্ড। আর দোকানে ঢোকার মুখেই পড়ে নিতে হয়—‘আপনি এখন সিসিক্যামেরার নজরে।’
ফন্দি-টন্দি নয়, এক্কেবারে বলে-কয়ে নজরবন্দি!
বহরমপুরের এক বস্ত্র প্রতিষ্ঠানে ঢুকে সেকেলে ক্রেতা গজগজ করেন, ‘‘আগে দোকানে ঢুকলে নিজেকে ভগবান না হলেও বেশ কেউকেটা মনে হতো! এখন যা লিখে রাখে তাতে নিজেদের কেমন তস্কর মনে হয়।’’
ব্যবসায়ীরাও দিচ্ছেন মোক্ষম যুক্তি, ‘‘কেনাকাটা না করলেও দেখাশোনা ফ্রি। কিন্তু ফ্রি-তেও মাঝেমধ্যে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যায়। অত লোকবলও নেই যে, এ সব খেয়াল রাখব।’’ যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিল যন্ত্র! অতিরিক্ত কর্মীর খরচও বাঁচল। বাড়ল নজরদারিও!
এমন চৌকিদারকে আর কে-ই বা হাতছাড়া করতে চায়। অতএব, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে পাহারায় বসে গেল সিসিক্যামেরা। রাতের বাগানে শুকনো পাতায় আওয়াজ তুলছে কে? ক্যামেরা জানিয়ে দেয়, শেয়াল নয়, অন্য কেউ। কুকুরটা অমন ঘেউ ঘেউ করছে কেন? মনিটরে ভেসে ওঠে ছায়ামূর্তির ভিড়।
ইট-মরসুমের শুরুতেই মুর্শিদাবাদের এক যুবক গোটা ভাটা মুড়ে দিয়েছেন সিসিক্যামেরায়। কালীপুজোর রাতে মনিটরের সামনে বসে হাসছেন তিনি, ‘‘দেখুন কর্তা, শ্যামাপোকাগুলোও কেমন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’’
আবার বোঝাও বড় কম নয়। বাড়িতে পড়াতে এসে গৃহশিক্ষক ঘা-কতক দিয়েছেন। চা দিতে এসে ছাত্রের মা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘‘প্রয়োজনে বকুন। কিন্তু ওর গায়ে হাত তুলবেন না প্লিজ।’’ শিক্ষক থতমত, ‘‘না, মানে ইয়ে...।’’ তাঁর চোখ খুঁজছে ঘরে বসানো ক্যামেরা।
বিপদ আরও আছে। নিরাপত্তা, নিয়ম, নজরদারিতে আর একা থাকার, একা হওয়ার জো নেই। মাঘের অলস বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে কেউ হয়তো বিড়বিড় করছেন, ‘তবু সে মাথার চারিপাশে,/ তবু সে চোখের চারিপাশে,/ তবু সে বুকের চারিপাশে!’
আচমকা দেখলেন বাড়ির সামনে এসে থামল দমকলের গাড়ি। চোঙা হাতে এক কর্মী রীতিমতো উদ্বিগ্ন, ‘‘আপনি শিগ্গির নেমে আসুন। জীবন এত ফেলনা নয়...।’’
বোঝো কাণ্ড!