তখনও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নাম বদলে জেলা পরিষদ হয়নি। সভাধিপতিকে বলা হতো চেয়ারম্যান। নদিয়ার এমনই এক চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ে। কৃষ্ণনগরে এখন যেখানে জজ কোর্ট, সেখানে তখন ছিল ফাঁকা মাঠ। গোটা মাঠ ঘিরে বাঁধা হয়েছে ভোজের ম্যারাপ।
পাত্র পুরুলিয়ার এক দাপুটে রাজপুত জমিদারের ছেলে। মাথায় পাগড়ি, কোমরে তরোয়াল। বাহন ঘোড়া। যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা রাজপুত্তুর। ভোজের পাতে পাল্টা খেল দেখালেন চেয়ারম্যানও। জাল ফেলে নিজের বেশ কয়েকটা পুকুর থেকে ধরা হয়েছিল রুই-কাতলা। নিমন্ত্রিতদের পাতে পড়ল একটি করে বিরাট মাছের মাথা। সঙ্গে মাছের অসংখ্য পদ। লোকে খেয়ে আর শেষ করতে পারে না। লোকে ধন্য ধন্য করতে লাগল।
এ দিকে, মেয়ের বিয়েতে এই ‘যৎসামান্য’ আয়োজনে নিমন্ত্রিতদের উপযুক্ত খাতির করতে না পারার জন্য চেয়ারম্যান বার বার আক্ষেপ করলেন জমিদার বেয়াইয়ের কাছে। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড়বাবু জীবনকানাই সাহা। বৃদ্ধ জীবনবাবু বলছেন, ‘‘সেকালে বহু পরিবারেই বিয়ের মতো শুভকাজে মাংস নিষিদ্ধ ছিল। ভোজের আকর্ষণ ছিল মাছ ও মিষ্টি।’’
তবে বিয়ের ভোজে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস বাঙালির বহু কালের। সে বেশিরভাগ ভোজের আসর বসত দিনে। সাদা মিহি চালের গরম ভাতে ঘি, কাঁচালঙ্কা আর নুন দিয়ে শুরু হত পরিবেশন। পাড়ার ছেলেরা গামছা কোমরে জড়িয়ে মাটিতে আসন পেতে বসা অতিথিদের পরিবেশন করতেন। ঘি ভাতের পরে আসত মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগের ডাল। সঙ্গে ‘পোড়ে ভাজা’ বা বেগুনি। কোথাও নানা সব্জি, ডাঁটা ও মাছের ‘কাঁটা’ দিয়ে একটা মনকাড়া ছ্যাঁচড়া।
তার পরেই শুরু হয়ে যেত মাছের পর্ব। ভোজের ওজন এই পর্বেই ঠিক হয়ে যেত। সম্পন্ন পরিবারের ভোজে এর পরে আসত পোলাও এবং আর মাছের কালিয়া। চাটনি, পাঁপড়ের পরে মিষ্টির পর্ব। রসগোল্লা, নানা রকমের সন্দেশ এবং লেডিকেনিই ছিল বেশ জনপ্রিয়। শেষ পাতে সাদা লাল-দই। খাওয়ার শেষে পান। তবে এ পান দোকানে সাজা নয়। ভোজের আগের রাতে বাড়ির মহিলারা নিজের হাতে পান সেজে খিলি করে লবঙ্গ দিয়ে গেঁথে রাখতেন। সামান্য কিছু বিয়ের ভোজে কালেভদ্রে খাসির মাংসের দেখা মিললেও ‘চিকেন’ নৈব নৈব চ।
এ যদি শহরাঞ্চলের সাধারণ মেনু হয়, গ্রামের দিকে ‘বিয়ের খানা’ ছিল অন্য রকমের। ভোজের আগের রাতে ভিয়েন বসত সম্পন্ন বাড়িতে। বোঁদে, রসগোল্লা, সন্দেশ এবং সাদা দইয়ের ব্যবস্থা থাকতই। অন্য দলের দায়িত্ব মাছ, মাংস ও অন্য তরকারি। মুসলিম বিয়েতে বরযাত্রী ঢুকলেই প্রথমে জলখাবারে ‘সালুন’ ছিল বাধ্যতামূলক। সঙ্গে রুটি, লুচি বা পরোটা দেওয়া হতো। সঙ্গে চৌকো করে কাটা আলুভাজা। জলখাবারের পরে বিয়ের পর্ব চুকলে দুপুরের খানা। তাতে মাংসের পদ বাধ্যতামূলক। যাঁরা মাংস খান না, তাঁদের জন্য মাছ। আম, টোম্যাটো কিংবা তেঁতুলের মধ্যে কোনও একটি দিয়ে তৈরি হত খাটা। শেষপাতে সাদা দই, বোঁদে, মিষ্টি কিংবা পায়েস।
সময় বদলে গেল। এল ক্যাটারিং। বহু জায়গায় বিয়ে সামাল দিচ্ছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজন। স্টার্টার হিসাবে জায়গা পেল ভেজিটেবল চপ, ডিমের ডেভিল, ফিস ফ্রাই, ফিস ফিঙ্গার কিংবা পনির পসিন্দা। তার পরে তন্দুর, লাছা পরোটা, চানা মশলা, চিলি পনির বা চিকেন আচার, ফ্রায়েড রাইস বা বিরিয়ানি কিংবা নানা কিসিমের পোলাও। সঙ্গে মাছ-মাংসের নানা পদ। ভোজন রসিকেরা অবশ্য এখনও বলছেন, ‘‘অধিকন্তু ন দোষায়।’’
(চলবে)