দান করা জমিতে মাটি বয়ে কাজের সূচনায় নইমুদ্দিন। —ফাইল চিত্র।
প্রথম শীতে, অঘ্রানের এক দুপুরে নিজের মেঠো উঠোনে বসে অস্ফূটে নইমুদ্দিন বলছেন, ‘‘রাস্তাটা আমাদের বড় আদরের, মন্দির-মসজিদ ভুলিয়ে একেবারে গলায় গলায় মিলিয়ে দিয়েছিল গো!’’
দু’পাশে ঘেসো জমি, হাত বিশেক চওড়া এক ফালি পথ, খোয়া পড়ব পড়ব করে এখনও পড়েনি। দু’কিলোমিটার অন্তে আঁকা খালের উপরে পোক্ত বাঁশের সাঁকো, এসডিও সাহেবের গাড়ি দিব্যি ধুলো উড়িয়ে দু’জেলার ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়।
কর সেবকদের উন্মাদনা এবং সেই সুতোয় জড়িয়ে ধর্মীয় হনন-আত্মহনন পর্বের আড়াই দশক পরে তাই ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সেই এক ফালি রাস্তা আর বৃদ্ধ নইমুদ্দিন।
নদিয়া আর মুর্শিদাবাদ, গায়ে গা লেগে থাকা দু’জেলার খান পঁচিশেক গ্রামের মানুষ গভীর আবেগে জানান, পঁচিশ বছর আগের সেই তপ্ত শীতে সম্প্রীতির সেই রাস্তা গড়তে জমিটুকু ছেড়ে না দিলে, সে পথে হয়ত রক্ত নদীই বইত! আর, লালবাগের সঙ্গে ডোমকল, দুই মহকুমার দূরত্বটা সেই ২২ কিলোমিটারেই থমকে থাকত।
লালবাগ মহকুমার ধরমপুর মৌজা থেকে ডোমকলের চর চাতরা, রাস্তাটুকু না গড়লে আর চলছিল না। কিন্তু জমি দেবে কে? নব্বই দশকের প্রথম ভাগে, বাবরি ভাঙার আবহে রাস্তার জন্য জমি দেওয়ার প্রশ্নে খান পঁচিশেক গ্রামের মধ্যে রেষারেষি তখন রক্তভাসি হয়ে ওঠার পথে।
থানা পুলিশ মামলা-মোকদ্দমার পরে হানাহানি শুধু সময়ের অপেক্ষা। হওয়ার উপক্রম। ঠিক সেই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন নইমুদ্দিন শাহ।
হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সেই শিক্ষকের কথা মনে পড়লে এখনও মাথা নিচু হয়ে আসে গ্রামীণ চিকিৎসক সুনীল মণ্ডল কিংবা ডাঙাপাড়া পঞ্চায়েত প্রধান সরিফুল ইসলামের, —‘‘ভাগ্যিস উনি ছিলেন!’’
ভৈরবের পূর্বপাড়ে ডোমকলের চর চাতরা। পশ্চিম পাড়ে লালবাগের ধরমপুর। নদীর দুই পাড়েই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বাস। সুনীল ডাক্তার বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগের কথা। জমিবিবাদে দু’টি মহকুমার সংযোগকারী ওই রাস্তাটা হয়ে উঠছিল না, জমি দেবে কে? কেউ ছাড়বে না জমি। প্রায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার উপক্রম।’’ সেই অগ্নিগর্ভ দিনে এগিয়ে এসেছিলেন মাস্টারমশাই। রাস্তা গড়তে তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ৬ বিঘা জমি। তাতেও হচ্ছে না দেখে ২ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছিলেন আরও ১২ কাঠা জমি। তার পর তা দান করেছিলেন রাস্তা গড়তে। ডাঙাপাড়া আর আশপাশের পাঁচ গ্রামের মানুষজন বলছেন, ‘‘আসলে এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি আর সম্প্রতি টিকিয়ে রাখা ছিল মাস্টারমশাইয়ের নেশা!’’
শুধু মুর্শিদাবাদই নয়, ওই রাস্তা তৈরি হওয়ায় বেঁচে গিয়েছে নদিয়ার করিমপুর-তেহট্টের হাজার হাজার গ্রামীণ মানুষ। কারণ করিমপুরের বাসিন্দাদের প্রায়ই ছুটতে হয় ডোমকল। ওই রাস্তা তাঁদের অন্তত ত্রিশ কিলোটামিটার দূরত্ব ছেঁটে দিয়েছে। করিমপুরের অসিত মণ্ডল বলছেন, ‘‘নইমুদ্দিন স্যার শুধু রাস্তা গড়েননি, দু ধর্মের মানুষের হাতে হাত ধরিয়ে দিয়েছেন!’’
২০ বছর অবসর নেওয়া রানিতলা থানার রাধাকান্তপুর কোলান হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক নইমুদ্দিনের আদি বাড়ি ধরমপুর। বাস করেন লালবাগ শহর লাগোয়া এলাকায়। শুধু রাস্তা কেন, কোনও হিন্দু কন্যার বিয়ে আটকে গেলেও তিনিই মসিহা। আবার নির্দ্বিধায় হাসপাতাল থেকে স্কুল গড়তেও বিলিয়ে দেন নিজের ধানি জমি। অসুস্থ শরীরে তিনি বলছেন, ‘‘জমির অভাবে উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র হবে না তা কি হয়, ধর্ম আবার কি, সক্কলে এসে চিকিৎসা করাবে তবেই না মজা!’’
কখনও স্থানাভাবে দীর্ণ অপরিসর আটচালায় রোদ-বৃষ্টি ভাসি স্কুলের চাতাল সম্প্রসারণ কখনও এক ফালি জমির অভাবে আড়ে বহরে বাড়তে না পারা নিতান্তই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার কখনও এত চিলতে রাস্তা— নিতান্তই অহেলায় মুখ গুঁজে থাকা গ্রামবাংলার এই চেহারাটা যখন ধর্মের আড়ালে বার বার মারমুখী হয়ে উঠেছে তখনই এগিয়ে এসেছেন নইমুদ্দিন। তাঁর এক ফালি উঠোনে বসে অসুস্থ বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘ধর্মের নামে ওই হনন-আত্মহনন বড় ভয়ঙ্কর বাবা!’’
পঁচিশ বছর পরে আজও সেই সম্প্রীতি বুনে রাস্তা দেখান নইমুদ্দিন।