ডাকসাইটে ব্যারিস্টার হিসেবে অতুলপ্রসাদ সেনের তখন বেশ নামডাক। মোকদ্দমার কাজে সে বার ভরা বর্ষায় গিয়েছেন হদ্দ এক মফস্সলে। উঠেছেন ডাকবাংলোয়। সারা দিনের কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে সাঁঝ নেমেছে। সঘন বর্ষার সেই রাতে অচেনা ডাকবাংলোয় একা অতুলপ্রসাদ। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির সঙ্গে ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের কোরাস। একটা পঙ্ক্তি উঁকি দিল গীতিকবির মনে, ‘ডাকিছে দাদুরি মিলন পিয়াসে, ঝিল্লি ডাকিছে উল্লাসে...।’ সাদা পাতায় খসখস করে লিখে ফেললেন।
অতুলপ্রসাদ নিজেই লিখেছেন, ‘‘কোনও একটি কেসে গিয়েছিলাম। ডাকবাংলোর বারান্দায় রাতে ডিনারের পর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বিশ্রাম করছি, বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। চোখে ঘুম আসছে না। ঝিঁঝিঁ পোকা ও ব্যাঙের ঐকতান শুনছি। মনটা উদাস হয়ে গেল। এই গানটি তখনই লিখেছিলাম।’’
একটা সময়ে ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁ কিংবা শেয়ালের ডাক ছিল বর্ষার সিগনেচার টিউন। সেই সব ডাক থেকে কত গান, কবিতার যে জন্ম হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই ছেলেটির কথা মনে আছে? রোগাটে চেহারা অবিকল ডেকে যেত পাখ-পাখালির ডাক। বর্ষার বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় তার গলায় সোনাব্যাঙ, কুনোব্যাঙ, শেয়াল ডাহুকের ডাক শুনে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়তেন অনেকেই। চোখের সামনে উঁকি দিত রংধনু ছেলেবেলা।
এ বারের বর্ষায় সেই ছিপছিপে হরবোলা আর নেই। গত বছর অগস্টে কান্দির পুরন্দরপুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শুভজিৎ সরকার স্কুল থেকে ফিরছিল। খড়গ্রামের হরিনারায়ণপুর ওই কিশোর কানা ময়ূরাক্ষীতে নৌকাডুবিতে মারা যায়। সেই হারিয়ে যাওয়া হরবোলার জন্য মন ভাল নেই হরিনারায়ণপুরের। কান্দির জেমো এন এন হাইস্কুলের শিক্ষক সূর্যেন্দু দে’র, “রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে আজ অনেক ধরনের জলজ জীব হারিয়ে গিয়েছে বর্ষার সেই হরেক ডাকও ক্রমশ কমে যাচ্ছে।’’
একটা সময়ে ব্যাঙের ডাকেই বর্ষা নামত। বাড়ির উঠোন থেকে নয়ানজুলি, সর্বত্রই শোনা যেত ব্যাঙের ডাক। বৃষ্টিভেজা মেঘলা রাতে সেই ডাকে কানে তালা ধরার উপক্রম হতো। বহরমপুরের হুমায়ুন আজাদ বলছেন, ‘‘গানের ধুয়োর মতো সেই ডাক শুনতে শুনতে কখন যে ঘুম চলে আসত টেরই পেতাম না। এখন সে সব কষ্ট কল্পনা। ব্যাঙই নেই তো ডাকবে কে!’’ স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলে চলেন, ‘‘সাঁঝ নামলেই গ্রামে গ্রামে এক দল মানুষ হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ-হ্যাজাক, বস্তা আর এক ধরনের জাল নিয়ে মাঠঘাট, পুকরপাড়, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই সব ব্যাঙ চালান হয়ে যেত দূরের মুলুকে। দেখতে দেখতে ব্যাঙই হারিয়ে গেল!’’
গ্রামাঞ্চলে তো বটেই মফস্সলেও বাড়ির পিছনে পুকুরপাড়ে, বাঁশবাগানে এমনকী উঠোনেও গভীর রাতে হুক্কা হুয়া ডাক শোনা যেত, মা-ঠাকুমারা বলতেন, ‘শেয়াল পডেছে!’ দৌলতাবাদের নিখিল সরকারের আজও মনে আছে ‘‘সন্ধ্যা হলেই বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। শেয়ালের অত্যাচারও কম ছিল না। দরমার বেড়া দেওয়া ঘরের বিছানা থেকে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত শিশুকেও শেয়াল মুখে করে তুলে নিয়ে যেত।’’
লালগোলার বৃদ্ধ হাবিল শেখের বয়স তখন বড়জোর কুড়ি-বাইশ। “এক রাতে হুক্কা হুয়া শুনে লাঠি হাতে বেরিয়েছি। দেখি, উঠোনের খাঁচা থেকে মুরগি বের করে সবে মুখে তুলেছে শেয়াল। পিঠে দিলাম লাঠির বাড়ি। হতচ্ছাড়া মুরগি ছেড়ে আমাকেই ধরল কামড়ে। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।” বলতে বলতে এখনও শিউরে ওঠেন হাবিল। শৈশবের সেই ডাহুকের ডাকও আজকাল তেমন শোনা যায় না। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে সাপের মুখে ধরা পড়ে যাওয়া ব্যাঙের সেই আর্তনাদ? হারিয়ে গিয়েছে তা-ও।
জিয়াগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষের আপশোস, ‘‘আগের সেই জলা জায়গাগুলোই তো আর নেই। খাদ, গর্ত, ডোবা, নয়ানজুলি সবই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতি বছর একটু একটু করে পিকে হয়ে আসছে বর্যার সেই সব ডাক।’’
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।