ধৃত ঝুমা মোহান্ত। —নিজস্ব চিত্র।
দু’মাসের শিশুকন্যাকে কুয়োয় ফেলে খুন করার অভিযোগে গ্রেফতার হল মা। এই ঘটনায় নবদ্বীপ শহর জুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, অভিযুক্ত মহিলা হয়তো মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। যদিও সত্যিই কি তা-ই? প্রশ্ন উঠছে। এলাকায় কান পাতলে এ-ও শোনা যাচ্ছে মেয়ে হয়েছিল বলে গঞ্জনা শুনতে হতো তাকে।
মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই খোঁজ মিলছিল না নবদ্বীপ পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডের বাসিন্দা লক্ষ্মীনারায়ণ মোহান্তের দু’মাস তিন দিনের শিশুকন্যা বন্দিনীর। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শিশুটির মা ঝুমা মোহান্ত দুপুর তিনটে নাগাদ তার বৃদ্ধা শাশুড়িকে প্রথম জানায় যে কেউ তার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। সে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছেন না। সঙ্গে সঙ্গে পাড়াময় হইচই পড়ে যায়। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কিন্তু শিশুটির কোনও হদিস না মেলায় সন্ধ্যার পর খবর দেওয়া হয় পুলিশে। পুলিশ এসে আর একপ্রস্থ খোঁজাখুঁজির পাশাপাশি ঝুমাকে শিশুটির বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলে অসংলগ্ন উত্তর দিতে থাকে সে। সন্দেহ হওয়ায় তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেরা শুরু করে পুলিশ। এক সময় ঝুমা স্বীকার করে নেয় যে সে-ই তার শিশুকন্যাকে বাড়ির কুয়োয় ফেলে দিয়েছে। বেশি রাতে কুয়োয় লোক নামিয়ে সেখান থেকে শিশুটির মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় মা ঝুমা মোহান্তকে।
বুধবার নবদ্বীপ থানায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে নিজের শিশুকন্যাকে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন ঝুমার স্বামী লক্ষ্মীনারায়ণবাবু। এ দিন ঝুমাকে নবদ্বীপ আদালতে তোলা হলে কোনও আইনজীবী তার হয়ে জামিনের আবেদন জানাননি। নবদ্বীপ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি নবেন্দু মণ্ডল জানান, “ধৃতের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের মামলা রুজু হয়েছে। এদিন তার হয়ে কেউ জামিনের আবেদন করেননি। বিচারক তার চোদ্দো দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।”
মন্দিরনগরী নবদ্বীপে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। শুধু তা-ই নয়, যে বাড়িতে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটিও শতাধিক বছরের প্রাচীন একটি মন্দির। স্থানীয় ভাবে ‘নামযজ্ঞের মন্দির’ নামে পরিচিত ওই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস। কোনও একসময়ে একটানা বারো বছর ওই মন্দিরে অবিরাম নাম সংকীর্তন চলেছিল। সেই থেকে নামযজ্ঞের বাড়ি নামেই পরিচিত মন্দিরটি। অভিযুক্ত ঝুমা ওই মন্দিরের বর্তমান সেবাইত লক্ষ্মীনারায়ণ মোহান্তের স্ত্রী। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সেটি নবদ্বীপের অন্যতম প্রধান মন্দিরময় এলাকা। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বলদেব মন্দির, গোবিন্দ বাড়ি, মদনমোহন মন্দির, বড় আখড়া, গোরাচাঁদের আখড়া,গম্ভীরা মঠ-সহ বহু মঠমন্দির ছড়ানো ওই এলাকায়।
ওই বাড়িতে বর্তমানে থাকতেন লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু, তাঁর স্ত্রী ঝুমা, বৃদ্ধা মা আরতি মোহান্ত এবং এক বোন গোপা গোস্বামী। লক্ষ্মীনারায়ণ কলকাতার এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী। মঙ্গলবার ঘটনার সময় তিনি নবদ্বীপে ছিলেন না। এই ঘটনার খবর পেয়ে বুধবার ভোরে নবদ্বীপে ফিরেছেন। তিনি জানান, “মঙ্গলবার দুপুরে আমি কলকাতায় কাজে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে মেয়েকে সুস্থ হাসিখুশি দেখে গিয়েছি। রাতে পুলিশ ফোন করে আমাকে ঘটনাটি জানায়। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কেন এমন ঘটল।”
কিন্তু ঝুমা দেবী কেন এমন একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটালেন? এই প্রশ্নের জবাবে লক্ষ্মীনারায়ণবাবু বারেবারেই বলেছেন “আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। পারিবারিক ভাবে আমাদের তেমন কোনও গোলমাল ছিল না। সংসারে একসঙ্গে থাকতে গেলে যেটুকু ঝগড়াঝাটি হয়, তার বেশি কিছু নয়।”
মঙ্গলবারের ঘটনা প্রসঙ্গে ৮২ বছরের বৃদ্ধা আরতি দেবী বলেন, “দুপুর থেকেই বাচ্চাটা খুব কাঁদছিল। এ জন্য বউমা ওকে দু’ঘা মারে। আমি এবং আমার মেয়ে খুব বকেছিলাম। এর পর তিনটে নাগাদ এসে আমায় বলে মেয়েকে নাকি কে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। শুনে আমরা কান্নাকাটি শুরু করে দিই। চিৎকার শুনে পাড়ার সকলে ছুটে আসে। অনেক খুঁজেও আমার নাতনিকে পাইনি। বাকিটুকু আর বলতে পারছি না।” এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা ঠাকুমা। শেষে তিনি বলেন “ওইটুকু দুধের শিশুকে যে মা মারতে পারে, সে মেরেও ফেলতে পারে। ওর কঠিন শাস্তি চাই।” লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর সঙ্গে বছরখানেক আগেই বিয়ে হয়েছিল দমদমের বাসিন্দা ঝুমার। গত ১১ মে, তাঁদের সন্তান হয়। লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর কথায় “সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই ওর আচরণে কিছুটা গোলমাল লক্ষ্য করেছিলাম। বন্দিনী আটমাসের মাথায় জন্মেছিল। অনেক কষ্টে ওকে বাঁচানো হয়েছিল। কিন্তু এ ভাবে ওকে চলে যেতে হবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, ঝুমা মানসিক ভাবে সুস্থ নন। জেরার উত্তরে দু’একটি অসংলগ্ন কথা ছাড়া বিশেষ কিছুই বলেননি। নবদ্বীপের আইসি তাপস কুমার পাল জানিয়েছেন, মহিলার এমন আচরণের কারন খুঁজতে তদন্ত করছে পুলিশ।