কীর্তন শুনতে গিয়ে রাত পেরিয়ে ভোর সুধারানির

এ হেন কীর্তনিয়াকে নিয়ে নানা কথা মুখে মুখে ছড়িয়েছে শহর জুড়ে। সন্ধ্যা নামতেই আসরে লোক ভেঙে পড়েছে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৭:৪০
Share:

প্রতীকী ছবি।

পঞ্চাশ বছর আগের কথা। নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়ির নাটমন্দিরে বসেছে কীর্তন আসর। কিংবদন্তি কীর্তনশিল্পী রথীন ঘোষ গাইবেন। কীর্তন জগতে তিনি তখন মুকটহীন সম্রাট। গা ভর্তি গয়না পরে কন্দর্পকান্তি রথীন ঘোষ যখন আসরে বসেন, সে এক দেখার মতো বিষয়। এ হেন কীর্তনিয়াকে নিয়ে নানা কথা মুখে মুখে ছড়িয়েছে শহর জুড়ে। সন্ধ্যা নামতেই আসরে লোক ভেঙে পড়েছে।

Advertisement

সেই ভিড়ে রথীন ঘোষকে এক ঝলক দেখার জন্য মহাপ্রভু বাড়িতে হাজির হয়েছেন শহরের অভিজাত পরিবারের বধূ সুধারানি ভৌমিক।

সে সময়ে সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে মহিলারা বড় একটা বের হতেন না। সুধারানির শ্বশুরবাড়ি তো আরও কঠোর এ সব ব্যাপারে। কিন্তু সুধারানি কাউকে কিছু না বলেই দু’-এক জন প্রতিবেশী মহিলার সঙ্গে চলে এসেছেন মহাপ্রভু বাড়িতে। ভেবেছেন, কত ক্ষণই বা লাগবে। গিয়ে রথীন ঘোষকে এক বার চোখের দেখা দেখবেন। তার পর চলে আসবেন।

Advertisement

সন্ধ্যা তখন সবে নেমেছে। ভাল করে দেখবেন বলে ভিড় ঠেলে সুধারানি একেবারে কীর্তনিয়ার মুখোমুখি। আসর আলো করে রথীন ঘোষ তখন গাইছেন ‘রূপের’ পদ। অপূর্ব সেই কীর্তনের অনাস্বাদিত অনুভূতি তাঁকে যেন অবশ করে ফেলল মুহূর্তে।

সুধারানির যখন সম্বিত ফিরল, তখন কীর্তন থেমেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন শেষ রাত্রি। নাটমন্দিরের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে বাজে ৩টে ২০।

কোথা দিয়ে গোটা রাত যে কেটে গিয়েছিল, সে কথা আজ আর মনে করতে পারেন না ৯০ পার করা সুধারানি। শুধু তাঁর মনে আছে, ভোর চারটের সময় ফিরে দেখেছিলেন বাড়ির দরজা বন্ধ। সকালে নানা নির্যাতন সহ্য করে, স্বামীর হাতে-পায়ে ধরে সে যাত্রায় কোনও মতে বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই যে পদাবলির সুরে জড়িয়ে গেলেন, আজও তার থেকে বেরোতে পারেননি সুধারানি।

নবদ্বীপের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে কীর্তন নিয়ে এমন হাজারো কাহিনি, যা গল্পকেও হার মানায়। মহাপ্রভু মন্দির ছাড়াও বড় আখড়া, সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির, গোবিন্দ বাড়ি, মদনমোহন মন্দির, সমাজবাড়িতে কীর্তনের ছোট-বড় আসর বসে বারো মাস। নবদ্বীপে গান করেননি এমন কীর্তনিয়া ভূ-ভারতে নেই।

সেই সব আসরে শুধু গায়ক নন, এমন সব মানুষ শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থাকতেন, বৈষ্ণব সমাজে যাঁদের স্থান অনেক উঁচুতে।

নবদ্বীপে কীর্তনের সূত্রপাত স্বয়ং মহাপ্রভুর হাত ধরে। গয়া ফেরত নিমাই পণ্ডিত সপার্ষদ সংকীর্তনে মেতে উঠলেন। আদ্বিজচণ্ডালের সমবেত প্রভাত কীর্তনে ঘুম ভাঙত নগরের। সবার আগে নৃত্যরত চৈতন্য। সান্ধ্যকীর্তনে ভরে উঠত গৃহস্থের উঠোন। গভীর রাতে গঙ্গার তীরবর্তী শ্রীবাসঅঙ্গন থেকে ভেসে আসত পদাবলির কীর্তনের আখর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন