মহড়া চলছে জোরকদমে।— নিজস্ব চিত্র
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল গ্রামে। রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটির ঝাপসা বাল্বটা একবার জ্বলেই দুম করে নিভে গেল। নিস্তব্ধ চারদিক। গাছের ডালে বসা নাম না জানা পাখিটা একবার ডেকেই ডানা ঝাপটে থেমে গেল।
হ্যারিকেন হাতে একটা ছায়ামূর্তি কোনও রকমে টাল সামলে কাদা প্যাচপেচে রাস্তা দিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ছোট্ট দোতলা বাড়িটায়। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই কেউ চিৎকার করে বলল, ‘‘এই সিঁদুরের মূল্য তুমি কী বুঝবে বিধুবাবু?’’
রহস্য ভাঙলেন গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা। গত তিন মাস ধরে ক্লাব ঘরের উপরে চলছে নতুন যাত্রাপালার মহড়া। সামনেই তো পুজো। সেখানে পালার বাজি হবে। প্রথম হতে পারলেই নগদ ১০ হাজার টাকা।
বেলডাঙার প্রত্যন্ত গ্রাম ঝাউবনা। প্রায় ১০০ বছর ধরে এই গ্রামে দুর্গা পুজো হচ্ছে। কিন্তু, সে পুজো আর পাঁচটা গ্রামের মতোই টিমটিমে। তেমন চমক কিছু ছিল না। পুজোর অন্যতম চমক যাত্রাপালা প্রতিযোগিতা। ঝাউবনা তো বটেই, গত ১৫ বছর ধরে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ এটাই। গ্রামের বাসিন্দারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এই চার দিনের জন্য।
বরাবর অবশ্য এমন ছিল না। চারদিন পুজো, আর দশমীতে ভাসান। এই ছিল রুটিন। রুটিনে বদল আনেন ভূমিপুত্র বাসুদেব বিশ্বাস। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা তিনি। সেখানে সফ্টওয়্যারের ব্যবসা তাঁর। ফি পুজোয় গ্রামে ফেরেন। বছর পনেরো আগে গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন তিনি। তাঁর স্মৃতিতে ছিল ছোটবেলায় দেখা যাত্রা পালা।
তিনিই বলেন, ‘‘গ্রামীণ লোকশিল্প তো হারিয়েই গিয়েছে। সেটাকে যদি কিছুটা ফিরিয়ে আনা যায়।’’ তিনিই প্রস্তাব দেন, যদি যাত্রা পালা করা যায়। গ্রামের বাসিন্দাদের প্রস্তাব ছিল, কলকাতার দল এনে পালা নামানোর। নাকচ করে দেন বাসুদেববাবু।
তিনি বলেন, গ্রামের লোকেদেরই পালা নামাতে হবে। সব খরচ তিনিই বহন করবেন। এমনকী চারদিনের চারটি পালার জন্য পুরস্কারও থাকবে। তার পরই শুরু হয়ে যায় যাত্রার দল তৈরি। গ্রামের চার পাড়ায় চারটি যাত্রা দল।
রথের দিন থেকে শুরু হয় মহড়া। পাড়ার লোকেরাই সেখানে অভিনেতা। তবে ‘ফিমেল আর্টিস্ট’ আনা হয় বাইরে থেকে। মঞ্চ থেকে মেক আপ আর্টিস্ট সব খরচই বহন করেন বাসুদেববাবু।
এবার উদয়ন সংঘ নাট্য নিকেতন নামাচ্ছে ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন ভালবাসা’। তারা মা অপেরার পালা ‘স্বামীর চিতা জ্বলছে, ভাঙা গড়া নাট্য নিকেতনের বাজি ‘সিঁন্দুর আছে স্বামী নেই’। আর যুব নাট্য নিকেতন প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে, ‘বৌ হয়েছে রঙের বিবি’ পালা নিয়ে।
এলাকার বিশিষ্টরা থাকেন বিচারক মণ্ডলীতে। প্রথম পুরস্কার ১০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ন’ হাজার টাকা। তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরস্কার যথাক্রমে সাড়ে আট এবং আট হাজার টাকা। সঙ্গে চার দলের চারটি ট্রফি।
গ্রামের পুজো কমিটির সম্পাদক দিব্যেন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘‘গ্রামে তো তেমন বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি শহর সেই ১৫ কিমি দূরের বেলডাঙা। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি পুজোর জন্য।’’ গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারা জানালেন, গ্রামের যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁরা আগে সব বার গ্রামে আসতেন না। যাত্রা প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর থেকে সবাই গ্রামে ফেরেন। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়রাও ভিড় করেন।
ঝাউবোনা উদয়ন সঙ্ঘ নাট্য নিকেতনের বিশিষ্ট অভিনেতা সঞ্জয় মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা একবার পৌরানিক একবার সামাজিক পালা নামায়। এবার সামাজিক পালা।’’
তবে উপড়ি পাওনাও রয়েছে। পুজোয় যাত্রা দেখতে এসে সরস্বতী পুজো, অন্যান্য সময়ের জন্য যাত্রা পালার বায়নাও করে যান আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। ভি জেলা থেকেও এখন যাত্রা পালার বায়না হয়।