জখম শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে। ইনসেটে, সেই সরকারি বাস। বৃহস্পতিবার জঙ্গিপুরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
ফরাক্কায় চলছিল সেতু সংস্কারের কাজ। এক লেনে আটকে পড়ে কয়েক হাজার ট্রাক। ফলে বাধ্য হয়েই একটা লেন দিয়েই চলছিল যাতায়াত। দু’টি যাত্রিবাহী বাসের মুখোমুখি ধাক্কায় মৃত্যু হল এক মহিলার। জখম ২০ জনকে জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক মহিলা-সহ দু’জনকে বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে শমসেরগঞ্জের আঁকুড়া এলাকার ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, ওই মহিলার নাম পলি মণ্ডল (২৬)। তাঁর বাড়ি ধুলিয়ান গরুর হাটপল্লিতে। জঙ্গিপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২০ জনের মধ্যে চার মহিলা , দু’জন শিশু ও এক স্কুল পড়ুয়াও রয়েছে।
ফরাক্কা সেতু সংস্কারের জন্য এ দিন যানজট ধুলিয়ান ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এক লেন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক হাজার লরি। ফলে ডান দিকের লেন দিয়ে চলছিল সমস্ত বাস ও অন্য যানবাহন। বেলা ১০টা নাগাদ মালদহের দিকে যাচ্ছিল ভিড়ে ঠাসা একটি বেসরকারি বাস। শমসেরগঞ্জের আঁকুড়া সেতুর ঠিক আগে যাত্রী তুলতে বাসটি দাঁড়ায়। তখন ওই লেনেই ফরাক্কার থেকে দুর্গাপুরগামী একটি সরকারি বাস আসছিল তীব্র গতিতে। সকাল থেকেই বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা ছিল ভিজে। পিছল রাস্তায় তীব্র গতিতে আসা সরকারি বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখোমুখি ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটিকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের পরে বেসরকারি বাসটি উল্টে যায় রাস্তার উপরেই। তার সামনের দিকটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ধাক্কা মারার পরে সরকারি বাসটি এগিয়ে যায় অন্তত ১০০ মিটার দূরে। দুই বাসের চালকই পলাতক। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন আশপাশের লোকজন। তাঁরাই জখম যাত্রীদের উদ্ধার করে নিয়ে যান পাশেই তারাপুর কেন্দ্রীয় বিড়ি শ্রমিক হাসপাতালে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পলি তাঁর স্বামী বিকাশ মণ্ডল ও সাত বছরের মেয়ে রিতিকাকে নিয়ে মঙ্গলবার পিসির শ্রাদ্ধে যোগ দিতে বাবার বাড়িতে এসেছিলেন। এ দিন ওই বেসরকারি বাসে তিন জনেই সেখান থেকে ফিরছিলেন শ্বশুরবাড়ি, ফরাক্কার জাফরগঞ্জে। কিন্তু তাঁর আর ফেরা হল না। রিতিকার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে।
ভাইপো সুব্রত সাহার বিয়ের বৌভাত ছিল বুধবার। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রঘুনাথগঞ্জের লবণচোয়া গ্রামে এসেছিলেন দুই খুড়তুতো বোন জয়ন্তী সাহা ও লক্ষ্মী সাহা। এ দিন মালদহে দু’জনেই তাদের শ্বশুরবাড়িতে ফিরছিলেন ওই বেসরকারি বাসেই। দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম জয়ন্তীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। তবে লক্ষ্মী সাহা বিপন্মুক্ত বলেই হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
তবে দুর্ঘটনার পরে আতঙ্ক কাটেনি লক্ষ্মীর। তিনি বলছেন, “বাসের মাঝামাঝি দু’জনে বসেছিলাম। কী ভাবে কী ঘটেছে তা বুঝতে পারেনি। আচমকা একটা বিকট আওয়াজ হয়। তার পরে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বুঝতে পারি আমাদের বাসটি উল্টে যাচ্ছে। বাসের যাত্রীরা সবাই আমাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। আমি তলে চাপা পড়ে গিয়েছিলাম। আমার উপরে ছিল দিদি জয়ন্তী। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার গোটা শরীর। দুই মহিলা আমাকে জড়িয়ে ধরে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন এক দোকানে।”
গুরুতর আহত নিত্য হালদার ছিলেন সরকারি বাসে। ফরাক্কা স্টেশনে আত্মীয়দের পৌঁছে দিয়ে তিনি ফিরছিলেন নিমতিতায়। তাঁর কথায়, ‘‘বাসের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম। বাসে বেশ গতি ছিল। বৃষ্টিও পড়ছিল টিপটিপ করে। আচমকা ভীষণ আওয়াজ করে টালমাটাল খেয়ে কিছু দূরে গিয়ে সরকারি বাসটি দাঁড়িয়ে পড়ে।” ডোমকলের মোক্তারপুরের বাবার বাড়ি থেকে বেসরকারি বাসে মালদহের নুরপুরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন ডালিয়া বিবি। সঙ্গে ছিল চার বছরের মেয়ে সুহানা ও দশ মাসের মেয়ে আফ্রিজা। তাদের পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন ডালিয়ার আত্মীয় মোশারোফ হোসেন। জখম চার জনকেই ভর্তি করানো হয়েছে জঙ্গিপুর হাসপাতালে। ডালিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
শেখপুরা মাদ্রাসার বছর নয়েকের ফায়িম আকতার শুক্রবার মাদ্রাসা ছুটি বলে বেসরকারি বাসে ফিরছিল ফরাক্কার শিকারপুরের বাড়িতে। দুর্ঘটনায় মাথা ও পায়ে গুরুতর চোট নিয়ে সে এখন জঙ্গিপুর
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এমনিতেই ফরাক্কা সেতু সংস্কারে এক লেন বন্ধ। অন্য লেনটি দিয়ে যাতায়াত করছে যানবাহন। তার উপর বৃষ্টিতে রাস্তা ছিল বেশ পিছল। তার ফলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এই দুর্ঘটনা।”