মঠের শহরে খেপের হাঁক

এক পশলা ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। কাক ভেজা দর্শকেরা নিজেদের তাতাতে খলবল করছেন। মাঠের কোণ থেকে গোলমালটা পাকিয়ে উঠল তখনই। খেলোয়াড়রা যেখানে ড্রেস করেন শোরগোলটা আসছে সে দিক থেকেই। ব্যাপার কি? ভিড়ে মাথা গলাতেই জানা গেল, ক্লাব টিমের এক খেলোয়াড় মাঠে নামার আগে চেয়ে বসেছেন বাড়তি ম্যাচ ফি।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০২:৫৩
Share:

এক পশলা ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। কাক ভেজা দর্শকেরা নিজেদের তাতাতে খলবল করছেন। মাঠের কোণ থেকে গোলমালটা পাকিয়ে উঠল তখনই।

Advertisement

খেলোয়াড়রা যেখানে ড্রেস করেন শোরগোলটা আসছে সে দিক থেকেই। ব্যাপার কি?

ভিড়ে মাথা গলাতেই জানা গেল, ক্লাব টিমের এক খেলোয়াড় মাঠে নামার আগে চেয়ে বসেছেন বাড়তি ম্যাচ ফি। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সাড়ে পাঁচশোয় হবে না। অভাবের সংসার, আরও তিনশো না দিলে ম্যাচ খেলবেন না।

Advertisement

মুরুব্বি গোছের এক জন জানাচ্ছেন, ‘‘তা তো চাইবেই, ও ক্লাবের পল্টুই যদি ম্যাচ পিছু চারশো নেয়, তো আমাদের এমন প্লেয়ারের খাঁই তো একটু বেশি হবেই।’’

নবদ্বীপের স্থানীয় লিগে, ‘খেপ’টা এমনই খুল্লমখুল্লা হয়ে গিয়েছে। আর কলকাতা ময়দানের সেরাদের মতোই তারাও দাবিটা টেনে হিঁচড়ে এনে ফেলছেন একেবারে ম্যাচের মুখে— টাকা না দিলে মাঠে নয়।

স্থানীয় এক ক্লাব কর্তা ফুট কাটছেন— ‘‘হবে নাই বা কেন, মিডিয়া রোজ সকালে যে ভাবে, কলকাতা ময়দানের প্লেয়ার আর ক্লাব কর্তাদের দর কষাকষির গল্প সামনে আনছে তা থেকে মফস্সলের প্লেয়াররা কিছু শিখবে না তা কী হয়!’’

তবে স্থানীয় ক্লাবগুলিতে সহৃদয় কর্তাও আছেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘সম্বৎসরের আয় তো এই ফুটবল থেকেই। এখন খালি পেটে ওরা খেপ খেলেছে। সেখানে দর কষাকষি না হলে পেট চলবে কী করে?’’

আর সে দাবি মেটাতে গিয়ে সাম্প্রতিক কালে হিমসিম খেতে হচ্ছে নবদ্বীপের বিভিন্ন ক্লাব কর্তাদের। অনেক সময়ে ম্যাচ ফি দিতে না পেরে টিমই নামাতে পারেনি কোনও ক্লাব, এ নজিরও রয়েছে। এক কর্তা তাই অভিমান করে বলছেন, ‘‘ধুর, সামনের বার টিমই করব না!’’

টিনের চাল, দরমার দেওয়াল, সকালে চিনিগোলা চায়ের সঙ্গে মোটা একটা পাঁউরুটি, ব্যাস— নবদ্বীপের দামি এক প্লেয়ারের কথায়, ‘‘এটাই আমাদের জীবন দাদা। টানাটানির সংসার। বাবা নেই। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর, এই মরসুমি ফুটবলেই যা কিছু আয়। তার পরে আধ পেটা খেয়ে রিকশা বা ভাড়া করা টোটোই আমাদের রুজির উপায়। তা এই সময়ে একটু ম্যাচ ফি নিয়ে দরদাম করব না!’’

মঠের শহরে খেপের এই হাঁকডাকে সরগরম এখন নবদ্বীপ।

বাস্তবিক ছবিটা তাই। ফুটবল থেকে সম্বৎসরের এই রোজগারটুকু কুড়িয়ে নিতে ওঁরা (প্লেয়ার) নিরন্তর খেপ খেলে চলেন। শরীরের দিকে নজর কোথায়? এক ক্লাব কর্তা বলছেন, ‘‘সময় মতো না খেয়ে, পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে অসুস্থও হয়ে পড়ে অনেকে। অনেকে চোট পেলেও চিকিৎসা হয় না। পরের মরসুমটা হয়তো খেলতেই পারল না। ওদের জীবনটাও বড্ড করুণ!’’

মঠ-মন্দিরের শহরে সম্প্রতি ‘সকার কাপ’ কিংবা ‘উত্তরণ কাপ’ এই ফুটবল জ্বর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় পুরসভার উদ্যোগে সকার কাপ বা পুলিশের উদ্যোগে উত্তরণ কাপের মতো টুর্নামেন্ট অসম্ভব জনপ্রিয়ও হয়েছে। এই টুর্নামেন্টগুলি ঘিরেই স্বপ্ন দেখে ক্লাব আর ফুটবলাররাও।

নবদ্বীপ স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক লাল্টু ভুঁইয়া বলেন, “টুর্নামেন্টে খেলতে হয় গোটা সাতেক ম্যাচ। আর লিগের খেলা মানে দশ-বারোটা ম্যাচ। দলের সংখ্যা যত বেশি হবে ততই বাড়বে খেলার সংখ্যা।’’ নবদ্বীপে এমন ফুটবল ক্লাবের সংখ্যা এখন নয় নয় করে ৫৫টি। ক্লাবকর্তারা জানাচ্ছেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্লেয়ারদের দরও। যে ছেলেটি দু’বছর আগেও ম্যাচ পিছু ২০০ বা ৩০০ টাকায় খেলে গিয়েছে, সে এ বার সাতশোর নিচে বলে পা দিতে চাইছেন না। আর পুরো লিগের জন্য চুক্তি করলে অন্তত দশ হাজার।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিয়ম অনুসারে প্রথম ডিভিশন প্রতিটি ক্লাবকে কম পক্ষে দু’টি ডিভিশনে জিতে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নবদ্বীপ স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের তার মধ্যে প্রথম বিভাগ খেলছে ৯টি দল, দ্বিতীয় ৫টি, জুনিয়ার ১৩টি, সাব জুনিয়ার ৪টি। গত বছর বন্যার জন্য নবদ্বীপে লিগ হয়নি। এ বার সকার এবং উত্তরণের সঙ্গে লিগও দোরগোড়ায়। ক্লাবগুলি, দল গড়া নিয়ে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে।

সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে, ‘সম্বৎসরের আয়ের’ জন্য প্লেয়ারদের দর হাঁকাও।

দেখা যাক কে জেতে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement