সকাল থেকে রোগীদের লম্বা লাইন। এক এক করে রোগীরা আসছেন। বহির্বিভাগে এসে তাঁরা নানা সমস্যার কথা বলছেন। সে সব কথা মন দিয়ে শুনছেন ‘ডাক্তারবাবু’। রোগ বুঝে ওষুধ দিচ্ছেন। রোগীর অবস্থা গুরুতর বুঝলে ‘রেফার’ও করে দিচ্ছেন তিনিই।
‘তিনি’ চিকিৎসক নন। তবে?
সরকারি ভাবে তাঁর পরিচয় ফার্মাসিস্ট। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসক না থাকার কারণে তাঁকেই বাধ্য হয়ে ‘ডাক্তারবাবু’ হতে হয়েছে। সাগরদিঘির গৌরীপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট অভিজিৎ পাখিরা বলছেন, ‘‘কী করব বলুন? ওঁরা এসে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। নিরুপায় হয়েই ডাক্তারি করতে হচ্ছে।’’
একই অবস্থা পড়শি জেলা নদিয়ার নন্দনপুরেও। করিমপুর ২ ব্লকের নন্দনপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক সময় অন্তর্বিভাগও চালু ছিল। কিন্তু তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু বছর হল। সেখানেও কোনও চিকিৎসক নেই। চিকিৎসার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘নিয়ম-টিয়ম জানি না বাপু। অসুখ-বিসুখে ওরাই আমাদের বড় ভরসা। সপ্তাহে ছ’দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা থাকে। চিকিৎসকের দেখা মেলে না। এখন ওরাও যদি ফিরিয়ে দেয়, তা হলে আমরা কোথায় যাব?’’
গৌরীপুর বা নন্দনপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমন দশা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বহু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসক নেই। দিনের পর দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলে বসে থাকেন ফার্মাসিস্টরা। শেষতক স্থানীয় লোকজনের অনুরোধেই তাঁরা হাতে তুলে নিয়েছেন স্টোথোস্কোপ।
নন্দনপুরের পরিমল বিশ্বাস বলেন, “চিকিৎসক না থাকায় আমাদের সমস্যার শেষ নেই। ফার্মাসিস্টরা যা করছেন সেটাই অনেক। না হলে ১৫ কিলোমিটার দূরে করিমপুর, নতিডাঙ্গা কিংবা ২৫ কিলোমিটার দূরে তেহট্টে ছুটতে হয়।” সাগরদিঘির চালতাবাড়ির বাসিন্দা জাকির হোসেন, হায়াতপুরের বাণী ইসরাইল জানান, এলাকা থেকে সাগরদিঘি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১২ কিলোমিটার। অথচ বাড়ির কাছে গৌরীপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। ফার্মাসিস্টের উপরে ভরসা করা ছাড়া উপায় কী?
নতিডাঙা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে নন্দনপুরে পালা করে এক জন চিকিৎসকের আসার কথা। নতিডাঙার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক শঙ্কর মণ্ডল বলছেন, “আমাদের ব্লকে চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। ফলে এখানকার চাপ সামলে চিকিৎসকদের যাওয়া সমস্যা হয়। তবুও প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসকদের এক দিন পাঠানোর চেষ্টা করি।’’ যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সপ্তাহ দূরের কথা, মাসের পর মাস চিকিৎসকের দেখা মেলে না।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব মতো, মুর্শিদাবাদের ৭০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৫০টিতেই চিকিৎসক নেই। নদিয়ার ৪৭টির মধ্যে চিকিৎসক নেই ১০টিতে। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি চালাচ্ছেন ফার্মাসিস্টরা। মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিরুপম বিশ্বাস বলছেন, “রাজ্যের কাছে চিকিৎসক চেয়েছি। চিকিৎসক পেলেই ওই সব প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাঁদের পাঠানো হবে।” নদিয়ার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায়ের কথায়, ‘‘আমরাও সরকারের কাছে চিকিৎসক চেয়েছি। নার্স, ফার্মাসিস্ট প্রাথমিক চিকিৎসা করছেন। ব্লকের চিকিৎসকেরা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা করেন।’’
কিন্তু এই ভাবে কত দিন চলবে? রোগীর ভিড় বাড়ে। সদুত্তর মেলে না।