মনের আড় ক্রমশ ভাঙছে!
কোনও লুকোচুরি নয়, সটান মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের যুবক কিংবা মহিলাও খুলে বলছেন তাঁর মনের সমস্যা। কলকাতা তো বটেই, মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের ভিড়ই জানান দেয়, পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটাই বদলেছে।
চিকিৎসকেরাও মানছেন, মনের খবর রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। কিন্তু সেটা যে জরুরি তা এখন বুঝতে পারছেন অনেকেই। রোগ পুষে না রেখে তাঁরা আসছেন, অসুবিধার কথা বলছেন— এটাই আশার কথা। বছর কয়েক আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম। কাউকে মনোবিদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেই হিতে বিপরীত হত। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতেন, ‘‘ডাক্তারবাবু আপনিই যা করার করুন। মনোবিদ মানেই তো পাগলের ডাক্তার।’’ কেউ আবার সেই চিকিৎসকের উপরে রাগ করে ছুটতেন আর এক জন চিকিৎসকের (মনোবিদ নন) কাছে।
কলকাতার মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার জানাচ্ছেন, এ ভাবে যে কত লোক বহু জায়গায় ঘুরে, অজস্র পরীক্ষা করিয়ে বিস্তর টাকা খরচ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। শেষতক নিরুপায় হয়ে তিনি মনোবিদের শরণ নিয়েছেন। জ্যোতির্ময়বাবুর কথায়, ‘‘তবে মানুষ এখন আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। শরীরের মতো মনেরও যে সমস্যা হয়, হতে পারে সেটা এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন।’’
যেমন বুঝতে পেরেছেন মুর্শিদাবাদের অঙ্কিত দত্ত (নাম পরিবর্তিত)। বছর পঁয়ত্রিশের অঙ্কিত কাজ করেন কলকাতার এক বেসরকারি সংস্থায়। অফিস, পরিবার ঠিকঠাক চলছিল। আচমকা অঙ্কিতের একটা সমস্যা শুরু হ’ল। মাঝেমধ্যেই তিনি ভয় পেতে শুরু করলেন। তাঁর মনে হতো, এই বুঝি তাঁর হার্ট অ্যাটাক হবে। হৃদস্পন্দন যেত বেড়ে। ঘামে ভিজে যেত সারা শরীর। শ্বাসকষ্ট হত। ইসিজি-সহ কিছু পরীক্ষা করিয়ে দেখা গেল, কোথাও সমস্যা নেই। তখন চিকিৎসক তাঁকে পরামর্শ দেন, মনোবিদের কাছে যাওয়ার। অঙ্কিত সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, এই সমস্যায় বহু মানুষ ভুগছেন। রোগটির নাম ‘অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার’। সামান্য কিছু ওষুধ ও নির্দিষ্ট কিছু যোগ-ব্যয়াম করে দিব্যি আছেন অঙ্কিত। তিনি বলছেন, ‘‘মনে হতো, মরে যাব। ভাগ্যিস, মনোবিদের কাছে গিয়েছিলাম।’’
তেহট্টের রেবা মণ্ডলও (নাম পরিবর্তিত) বাড়ির বাইরে বেরনো বন্ধ করে দিতেন। কারও সঙ্গে কথাও বলতেন না। রেবা বলছেন, ‘‘মনে হত, সবাই আমাকে দেখলে হাসাহাসি করবে। তার পর স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে মনোবিদের কাছে যাই। এখন আগের থেকে অনেকটাই ভাল আছি।’’ তিনি একা নন, তার বছর পনেরোর ছেলে অকারণে মিথ্যে বলছিল। ছেলেকেও এক দিন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন মনোবিদের কাছে। রেবা বলছেন, ‘‘মিথ্যে বলাটা আর যাই হোক, শরীরী সমস্যা হতে পারে না।’’
করিমপুরের গ্রামীণ হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলছেন, ‘‘আড় ভাঙানোয় সব থেকে বড় ভূমিকা কিন্তু সাধারণ চিকিৎসকের। রোগ নির্ণয়ের সময় প্রাথমিক ভাবে তাঁরাই বুঝতে পারেন যে, রোগ মনের। সেক্ষেত্রে তাঁদের উচিত, রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে বুঝিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো। প্রথম দিকে, অনেকেই মনোবিদের কাছে না গিয়ে কলকাতা কিংবা বাইরে যেতেন। এখন তাঁরা কৃষ্ণনগর, কল্যাণী বা বহরমপুরেও যাচ্ছেন।’’ কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কৌস্তভ চক্রবর্তী বা মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের রঞ্জন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘বহির্বিভাগের ভিড় দেখলে বুঝতে পারবেন, মনের কথা খুলে বলছেন অনেকেই।’’
কেমন কথাটার সঙ্গেও তো লেপ্টে থাকে মন! কেমন আছেন বললে যদি উত্তর মেলে, ‘আহা কী রোদ ঝলমলে দিন। ডিপ্রেশন উধাও!’, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে সেটাই বোধহয় সবথেকে বড় প্রাপ্তি!