নদী ভাঙে গ়ড়েও দেয় নদী। সারাটা বছর সর্ষে, ধান আর শীতের সব্জি, বর্ষার ফুঁসে ওঠা পদ্মা, শীতে বয়রা মাঠের রোদ্দুর, আনাজ-মুরগির ডিম নিয়ে মূল ভূখন্ডে পাড়ি দিয়ে নুন-তেল-কেরোসিনের মতো দিন যাপনের অপরিহার্যের খোঁজ করা। চরের জীবনে এই চেনা যাপন চিত্রে ভিনদেশি নাবিকের মতো পাঁচ বছরে পা পড়ে যাঁদের মানুষ তাঁদের বলেন, ‘‘ওই বালি হাঁসেরা এলেন!’’ শীতের পরিযায়ী বালি হাঁসের মতোই তাঁদের পাঁচ বছরে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে চরে পা দেওয়া তার পর, এক্কেবারে উধাও হয়ে যাওয়া।
তা নিয়ে অভশ্য তেমন হেলদোল নেই চরের মানুষজনের। তাঁরা জানেন, চরের ঝড়-বাদলার মতোই ওঁরা আসেন, আবার কথা না রেখে হারিয়ে যান। গত সাড়ে তিন দশকে এর কোনও বদল হয়নি। জলঙ্গির উদয়নগর খণ্ড এমনই এক চর। ভোটের বুথ খুঁজতেও যাঁদের সাড়েনি তিন কিলোমিটার বালির চর ভেঙে পৌঁছতে হয় ভোট বাক্সের কাছে। ৬৩টি পরিবার নিয়ে এ ভাবেই জেগে আছে উদয়নগর খণ্ড।
হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা পরিবার, তবে, ভোট সবার এক জায়গায় নয়। তাদের কয়েক জনকে নদী ভেঙে পাড়ি দিতে হয়, কখনও সাগরপাড়ায় কখনও বা চোয়াপাড়া। অথচ চরের কাছেই ঘোষপাড়া পঞ্চায়েতে দিব্যি বুথ রয়েছেচ। চরের আকবর আলি বলছেন, ‘‘খামোকা কেন বলুন তো সাত-দশ কিলোমিটার হাঁটব, ভোট চাইতে এলে কত বার বলেছি, কিচ্ছি করতে হবে না, এটুকু শুধু করে দিন....কাজ হয়নি!’’ ১৯৯২ সাল। পদ্মার ভাঙনে উদয়নগর গ্রামটি জলঙ্গির মানচিত্র থেকে মুছে যায়। তার পরে গোদাগাড়ি ও সাহেবরামপুর এলাকায় পুনবার্সন দেওয়া হয় ভাঙনগ্রস্থ পরিবারগুলিকে। কিন্তু পরে চর জেগে ওঠার পরে নিজের জমিতে ফসল ফলাতে আবারও পদ্মার ওপারে বসবাস শুরু করে পরিবারগুলি। আর তখন থেকে চর উদয়নগর খণ্ড তাদের ঠিকানা। সুশান্ত সরকারের কথায়, ‘‘আমাদের যেখানে পূনবার্সন দেওয়া হয়েছিল সেখানে এক চিলতে জমি। ভোট বাবুরা বিশ বছর ধরে ভরসা দিয়ে আসছেন, নাহ, কাজ হল না।’’ বালিকর চর ভেঙে ভোট দিতে আসা জীবন অধিকারী বলছেন, ‘‘কত আর বলব বলুন তো, দিনে দু’বার আমাদের প্রমাণ দিতে হয়, আমরা ভারতীয়। তার পর চর ভেহে বুথে পৌঁছে যদি বাংলাদেশি বলে তাড়িয়ে দেয়? নাহ, আর ভোট দিই না!’’ সেই অপার নেই-এর জগতে চর উদয়খণ্ড তাই ভোট নয়, তাকিয়ে থাকে পদ্মার দিকে!