মায়াপুরে ইসকন মন্দিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
এ মায়াপুর কোন মায়াপুর? সোমবার সকাল থেকে গোটা শহর জুড়ে থমথমে ভাব। বাস, টোটো ভ্যানরিকশায় জট পাকানো ঘিঞ্জি রাস্তাটা বিলকুল ফাঁকা। উধাও পর্যটকের চেনা ভিড়। পথে পথিকের থেকেও বেশি পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার্স।
চায়ের দোকানে ভিড় নেই। আড্ডা নেই। রবিবার থেকে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে, কোথাও কোনও গুলতানি চলবে না। এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন মায়াপুরে। তবুও কি আর কৌতূহল চেপে রাখা যায়! চারদিকে উৎসুক মুখের ইতিউতি চাউনি। ইস্কন মন্দিরের মূল প্রবেশ পথে একমাত্র পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ছাড়া কারও প্রবেশ অধিকার নেই।
মন্দির চত্বর ততক্ষণে দুর্গের চেহারা নিয়েছে। ব্যারিকেড, মেটাল ডিটেক্টর গেট, নাগাড়ে তল্লাশি। সব মিলিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। দুপুর বারোটা-সওয়া বারোটার সময় হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে গমগম করে মায়াপুর ইস্কন মন্দির। প্রসাদের জন্য লম্বা লাইন, সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠে থিকথিকে ভিড়, সমাধি মন্দিরের সিঁড়িতে-চাতালে নিজস্বী তোলার হুড়োহুড়ি থাকে। এ দিন সব ভোঁ ভোঁ। গোটা মন্দিরে জনাকয়েক বাছাই করা ভক্ত, নিরাপত্তা কর্মীদের ছোটাছুটি। ইস্কনের মূল মন্দিরে ঢুকে সকলে অবাক। কয়েক হাজার বর্গফুটের জনমানবশূন্য নাটমন্দিরের মাঝে বসে তিন জনের একটি দল কীর্তন গাইছে। বিগ্রহের মঞ্চে জনাচারেক পূজারী। মন্দিরে আলপনা দিচ্ছেন বিদেশি ভক্তেরা।
বেলা একটা নাগাদ এলেন ফোর্ড। চোখ বুলিয়ে নিলেন চারদিকে। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে হাসি মুখে দাঁড়ালেন বটে। তবে মুখে কুলুপ। ইতিমধ্যে খবর এল, তিনি আসছেন। মুহূর্তে বদলে গেল পুরো ছবিটা। সবার চোখ আকাশের দিকে। মন্দিরের মূল প্রবেশপথে মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পৌঁছে গিয়েছেন ফোর্ড, ভক্তি পুরুষোত্তম দাস, ভক্তিচারু মহারাজ প্রমুখেরা। পাশের হেলিপ্যাড থেকে কনভয় থামল ইস্কন মন্দিরের দরজায়। অভ্যর্থনা জানাতে গেটে সামনে প্রায় জনা তিরিশ খুদে বিদেশি গেয়ে উঠল কীর্তন। হাতজোড় করে এগিয়ে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘড়িতে তখন বেলা দেড়টা। কয়েক পা হেঁটে মন্দিরে ঢোকার আগেই থমকে দাঁড়াতে হল। কী ব্যাপার? পায়ে চটি আছে যে! ফের পিছিয়ে চটি খুলে সোজা মন্দিরে। মূল মন্দিরে ততক্ষণে পর্দার অন্তরালে বিশ্রামে গিয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছতেই সরিয়ে দেওয়া হল সবুজ পর্দা। শুরু হল বিশেষ পুজো। নিজের হাতে বিগ্রহ আরতি করলেন মমতা। কয়েক মিনিট সেখানে কাটিয়ে পাশের পঞ্চতত্ত্ব মন্দিরে যাওয়ার পথেই নৃসিংহদেবের বিগ্রহ। প্রণাম করে পৌঁছন পঞ্চতত্ত্ব মন্দিরে। সেখানেও মুখ্যমন্ত্রী আরতি করেন নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাচার্য, শ্রীবাস প্রমুখ পঞ্চপার্ষদের সঙ্গে চৈতন্যদেবের বিগ্রহ। সেখানেই কথা হয় ফোর্ড এবং ইস্কন প্রধানদের সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আগে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ফোর্ড তুলে দেন দু’টি রাধা ও কৃষ্ণমূর্তি। সেটি হাতে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ইস্কন কর্তৃপক্ষকে বলেন, ‘‘এই মূর্তি এখানেই থাকবে। নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবেন। আমি এসে দেখব।’’ সেখান থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যান সমাধি মন্দিরে। সেখান থেকে দু’টো নাগাদ মমতার কনভয় ছুটল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, চৈতন্যমঠের উদ্দেশে। মায়াপুর ভক্তিবিনোদ ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। গাঁদা ফুলের পাপড়িতে মায়াপুর রোডের রং তখন গাঢ় হলুদ। চৈতন্যমঠে মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মাননা প্রদান করেন চৈতন্যমঠ কর্তৃপক্ষ। মঠাধ্যক্ষ ভক্তি কুমুদপুরী জানান, শতবর্ষের উৎসবে মন্দিরে আসার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে কলকাতায় গিয়ে তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কথা রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মঠ সভাপতি ৯৮ বছরের কানুপ্রিয় দাসকে মালা পরিয়ে সম্মান জানান মুখ্যমন্ত্রী। চৈতন্যমঠের তরফে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় অনেক বই। মুখ্যমন্ত্রী বলেন “বই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার সঙ্গে সবসময় বই থাকে। এগুলো সঙ্গে যাবে।” বইয়ের পাঁজা হাত থেকে ফেলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মৃদু ধমক খান নিরাপত্তা কর্মী। মমতা তাঁকে বলেন, “সবসময় বইয়ের যত্ন করবে।” এরপরে কনভয় থামে বামুনপুকুরের মোড়ে। গাড়ি থামিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঢুকে পড়েন চাঁদ কাজীর সমাধিতে। সেখানে ফুল দিয়ে কয়েক মিনিট কাটিয়ে মমতা রওনা দেন কৃষ্ণনগরের দিকে।