দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও মহারাজা নন্দকুমারের পরিবারের উত্তরসূরি মহিলারা কার্যত অসূর্যস্পর্শা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে নন্দকুমারের পরিবারের মহিলাদের কোনও ছবিও মেলে না। রাজ পরিবারের অন্তঃপুরের কোনও ছবি নেই দেখে বহরমপুরের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার তথা রাজবাড়ির ঘনিষ্ঠ ভেন্টু জেদ ধরেন নন্দকুমারের পঞ্চম উত্তরসূরি গৌরীশঙ্কর রায়ের সস্ত্রীক ছবি তুলবেন। সেই ফ্রেমে বিধবা রানিমাকেও রাখবেন বলে অনুনয়-বিনয় শুরু করেন ভেন্টু। রাজবাড়ির পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে বিধবা রানিমার ছবি তোলা সেকালে বিধবা বিবাহের মতোই অসাধ্যসাধন ছিল। কিন্তু, নন্দকুমারের বাড়ির মহিলাদের প্রথম ছবি তুলে বিপ্লব ঘটাবেন— এমনই তাঁর জেদ।
প্রায় ৬৫ বছর আগের কথা। গৌরীশঙ্কর তখন ২২ বছরের রাজপুত্র। তাঁর সঙ্গে নদিয়ার বৈরগাছির জমিদারের মেয়ে ১৩ বছরের দীপ্তিরানির বিয়ের সম্বন্ধ পাকা। বিয়ে করতে চলেছেন গৌরিশঙ্কর। জেনে নিয়েছেন, হবু শ্বশুরবাড়িতে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা নেই। বরযাত্রীর সঙ্গে ফটোগ্রাফারও বেঁধে নিলেন
তিনি। ফটোগ্রাফার হিসাবে বহরমপুর শহরে ভেন্টুর নামডাক ছিল। স্টুডিও ছিল ‘ভেন্টুজ স্টুডিও’। গৌরীশঙ্করের থেকে ভেন্টু আট-দশ বছরের বড়। রাজপুত্র গৌরীশঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘তবুও বন্ধু ছিলাম। বিয়ে বাড়ির অনেক ছবি তোলা হল। কিন্তু মুশকিল বাধল তাঁর একটা আবদার ঘিরে।’’
বহরমপুর শহরের কুঞ্জুঘাটার রাজবাড়িতে ফিরে তাঁর আবদার পর্দানসীন রানিমার সঙ্গে নবদম্পতির ছবি তুলবেনই। অসূর্যম্পশ্যা রানিমা সর্বমঙ্গলাদেবীর ছবি উঠবে দিনের আলোয়! অনেক সাধ্যসাধনার পরে উঁচু পাচিল ঘেরা ছাদে নবদম্পতির সঙ্গে হাজির হলেন তিনি। মধ্যিখানে রানিমাকে বসিয়ে তোলা হল রাজপরিবারের অন্তঃপুরের মহিলাদের প্রথম ছবি। সেই ‘ঐতিহাসিক ছবি’ তোলার কথা স্মরণ করেন নব্বুই ছুঁই ছুঁই গৌরিশঙ্কর রায়। তিনি বলেন, ‘‘মাথা থেকে লম্বা ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকলেন মা। মায়ের কথা, ওই ভাবেই ঘোমটা সমেত ছবি তুলতে হবে। ভেন্টুদাও ঘোমটা ছাড়া ছবি তোলার দাবিতে অনড়। দু’জনের জেদে দু’জনেই অবিচল। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে সটান শুয়ে পড়ে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে ভেন্টুদার সে কী করুণ মিনতি! অবশেষে ঘোমটা উঠল।’’ অচলায়তন ভেঙে মহারাজ নন্দকুমারের বাড়ির প্রথম একজন মহিলার ছবি উঠল। সৌজন্যে এক ফটোগ্রাফারের অদম্য লড়াই।
বহরমপুরের ফটোগ্রাফির ইতিহাসের শুরু কবে? আগামী বুধবার বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবসের আগে সে নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা।
অর্থাভাব ও জলকষ্টে বিশ্বভারতী বন্ধ হওয়ার মুখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পর্কে লালগোলার দানবীর মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের বৈবাহিক। প্রস্তাব মেনে লালগোলার মহারাজার দানে সঙ্কট কাটল বিশ্বভারতীর। সেই সময় বিশ্বভারতীতে টাঙিয়ে রাখার জন্য রামেন্দ্রসুন্দরের মাধ্যমে
যোগীন্দ্রনারায়ণের ‘ফটোগ্রাফ’ চেয়ে পাঠালেন কৃতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ। এক হাতের দান অন্য হাতকে জানতে না দেওয়ার নীতিতে মহারাজা সারা জীবন অবিচল ছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীতে নিজের ফটো টাঙানোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে, ঊনবিংশ শতকে মুর্শিদাবাদে ফটোগ্রাফির চর্চা ছিল। এই বিষয়ে প্রমাণও আছে। ১৯০৭ সালের ৪ এবং ৫ নভেম্বর বহরমপুর শহরের কাশিমবাজার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রাসাদে উনিশ শতকের নবজাগরণের পথিকৃতদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দু’টি ছবি তোলা হয়। কাশিমবাজার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৭ সালের ৩-৪ নভেম্বর প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি-পুরাতত্ত্ব-বিজ্ঞান জগতের দিকপালেরা ছিলেন। সংখ্যায় প্রায় ৪০০ জন। সঙ্গে ছিলেন মাসিক পত্রিকার ‘জাহ্নবী’র সহ-সম্পাদক ও প্রকাশক নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত। সাহিত্য সম্মেলনের প্রায় এক বছর পর ‘জাহ্নবী’র চতুর্থ বছরের চতুর্থ সংখ্যায় নলিনীরঞ্জন লেখেন, ‘‘সমাপ্তি অধিবেশনে দিনে রবীন্দ্রনাথকে মধ্যমণি করে সাহিত্যসেবীদের নিয়ে একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়...। পর দিন ১৯ কার্তিক (৫ নভেম্বর) মণীন্দ্রচন্দ্র, লালগোলার মহারাজা প্রমুখ ও স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের নিয়ে গ্রুপ ছবি তোলা হত।’’
তিনি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেই সময় সমবেত তরুণ সাহিত্যসেবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। তখন সকলের অনুরোধে ‘অয়ি ভূবনমোহিনী’ গানও গেয়েছিলেন। নলিনীরঞ্জনের কথায়, ‘‘ইত্যাবসরে রবীন্দ্রবাবুর কক্ষে গিয়া তাঁহাকে স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত ফটো তুলাইবার জন্য অনুরোধ করিলাম। দু’একজন সময় অল্প বলিয়া আপত্তি করিলেন... রবীন্দ্রবাবু হাসিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। রবীন্দ্রবাবুকে মাঝে বসাইয়া স্বেচ্ছাসেবকগনের ফটো তোলানো হইল।
অল্পক্ষণ পরেই রবীন্দ্রবাবু কলিকাতা যাত্রা করিলেন।’’
এই ঘটনা প্রমাণ করে মুর্শিদাবাদে ফটোগ্রাফি চর্চার শুরু তারও আগে। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অবসরপ্রাপ্ত অধিকর্তা অশীতিপর মৃণাল গুপ্তের মত, কলকাতার বাইরে প্রথম বাংলা ও ইংরাজি সংবাদপত্র প্রকাশ, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম বইমেলা, প্রথম মহিলা সম্পাদিত পত্রিকা প্রকাশ, প্রথম সঙ্গীত আকাদেমি প্রতিষ্ঠা, নাট্য আকাদেমি প্রতিষ্ঠায় বহরমপুর ফটোগ্রাফি চর্চা আন্দোলনেও অন্যতম পথিকৃৎ।
(চলবে)