শান্তিপুর কি তবে আবার অশান্ত হয়ে উঠছে?
সোমবার বিকেলে আগমেশ্বরীতলায় বোমাবাজির ঘটনার পরে এই প্রশ্নটাই ঘোরাফেরা করছে শহরে। বছর দু’য়েক আগে শান্তিপুর কলেজকে কেন্দ্র করে বার বার অশান্ত হয়েছে এই শহর। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে। কিছুদিন শহর শান্ত থেকেছে। তারপর ফের শুরু হয়েছে গণ্ডগোল। দুয়ারে নির্বাচন। তার আগে সোমবারে যে ভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমাবাজি করে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল দুষ্কৃতীরা, তাতে রীতিমতো শিউরে উঠেছে শান্তিপুর। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
সোমবারের ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, সাত-আট জনের একটি দুষ্কৃতী দল হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার ভিতরে ঢুকে পড়ল। আগমেশ্বরী মন্দিরের সামনের মাঠে বাচ্চারা খেলছিল। সেখান থেকে একটু দূরে তাস খেলছিলেন প্রবীণেরা। দুষ্কৃতীরা বোমাবাজি শুরু করল। বোমার শব্দে যারা ছুটে এলেন তাদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হল। বাচ্চাদের কোনওরকমে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে গেলেন অভিভাবকেরা। ছুটে পালাতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে জখম হলেন কয়েকজন। তারপর দুষ্কৃতীরা অবাধে বোমা ফাটিয়ে হেঁটে এলাকা ছেড়ে চলে গেল। ওই ব্যক্তি বলছেন, ‘‘রাজনীতির কারবারিরা কী বলছেন তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, শহরের নিরাপত্তা কোথায়? পুলিশ-প্রশাসনই বা কী করছে? এরপর তো লোকজন রাস্তায় বেরোতেও ভয় পাবেন।’’
এ দিনের বোমাবাজির ঘটনায় শান্তিপুর কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক টিএমসিপির মনোজ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রাজা পাল, বাপ্পা দাস, ভোম্বল শেখ-সহ মোট ছ’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। পুলিশ মঙ্গলবার রাতে ভোম্বলকে শান্তিপুরে তার বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করেছে। জেলার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বোমাবাজির ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে।’’ কিন্তু শান্তিপুরে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য রুখে দেওয়া যাচ্ছে না কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘আমরাও কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। এর আগে যখনই গণ্ডগোল হয়েছে আমরা তখনই পদক্ষেপ করেছি। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছি। এ বারেও অভিযুক্তেরা কেউ রেহাই পাবে না।’’
কিন্তু এমন আশ্বাসে বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না শান্তিপুর। অভিযোগ, বেশ কয়েক দিন ধরে এলাকার কয়েকজন দুষ্কৃতী স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা চাইছিল। ব্যবসায়ীরা সেই টাকা দিতে অস্বীকার করায় দুষ্কৃতীরা এ দিন বোমাবাজি করেছে। ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তখনও এই একই আশ্বাস দিয়েছে। শান্তিপুর কলেজ হোক কিংবা বাজার, বার বার এমন ঘটনা ঘটছে কেন?
শান্তিপুর কলেজ নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ, বেশ কয়েকবছর ধরেই এলাকার উঠতি সমাজবিরোধীরা কলেজে যাতায়াত শুরু করেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা কলেজের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে তা নিয়ে যখনই শাসক দলের ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হয়েছে তখনই ওই সমাজবিরোধীদের ব্যবহার করা হয়েছে। কলেজের ভিতরে হোক বা বাইরে তা নিয়ে তুলকালামও হয়েছে। শহরে ‘দাদাগিরি’ করার ক্ষেত্রেও ওই যুবকেরা প্রশ্রয় পেয়েছে ছাত্রনেতাদের একাংশের। এরপরেই শান্তিপুর কলেজে টিএমসিপির নেতা হিসাবে উঠে আসে মনোজ সরকারে নাম। সঙ্গে হাসিবুল শেখ। এই কলেজে বরাবরই এসএফআই ও ছাত্রপরিষদের মধ্যে লড়াই হয়েছে। টিএমসিপি তেমন দাঁত বসাতে পারেনি। কিন্তু মনোজ-হাসিবুলের হাত ধরেই টিএমসিপি এই কলেজে প্রভাব বাড়াতে শুরু করে। বিরোধীদের দাবি এই উত্থানের পিছনে অন্যতম বড় কারণ মনোজ ও হাসিবুলের সঙ্গে এলাকার উঠতি দুষ্কৃতীদের ঘনিষ্ঠতা।
ফলে কলেজের ভিতরে তো বটেই কলেজের বাইরেও গোলমাল কম দেখেনি এই শহর। একসঙ্গে দাপিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও পরে অবশ্য মনোজ ও হাসিবুলের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০১৪ সালে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে মনোজ ও হাসিবুলের গোষ্ঠীর মধ্যে চরম বিবাদ শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠতে থাকে। এই সুযোগে এলাকার দুষ্কৃতীরা আরও বেশি করে কলেজের ভিতরে যাতায়াত শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হয় মনোজ সরকার। সহ সভাপতি হয় সাধারণ সম্পাদক পদের অন্যতম দাবিদার হাসিবুল শেখ। আর সহকারি সাধারণ সম্পাদক হয় মনোজের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা বলে পরিচিত ফিরোজ আলি শেখ।
মনোজের নেতৃত্বে বিজয় মিছিল বের হলে সেই মিছিলে গুলি চলে বলে অভিযোগ ওঠে। মনোজের এক অনুগামীর পায়ে গুলি লাগে। পুলিশ সেই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিলেও কলেজে গোলমাল কিন্তু চলতেই থাকে। এরমধ্যেই শান্তিপুর কলেজে গুলি ও বোমাবাজি। ওই ঘটনায় পুলিশ মনোজ সরকার ও হাসিবুল শেখকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে অবশ্য মনোজ-হাসিবুলদের দূরত্ব অনেকটা কমেছে বলেই খবর।
২০১৪ সালের জুলাই মাসে শান্তিপুরের মানিকনগরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন এক বৃদ্ধা। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে এলাকার সমাজবিরোধী আবু শেখ ও আমিরুল শেখের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরেই এই খুন। পরে পুলিশ অবশ্য তাদের গ্রেফতার করে। সোমবারে আগমেশ্বরীতলায় নতুন করে বোমাবাজি ও গুলির ঘটনা পুলিশকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে। জেলা পুলিশের একাংশের মতে, মনোজের গোষ্ঠী বর্তমানে এতটাই বড় হয়ে গিয়েছে যে নিজেদের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে গণ্ডগোল। আর এরই মধ্যে কলেজে যাতায়াত শুরু করেছে মনোজের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ছেলেরাও। সব মিলিয়ে ভিতরে ভিতরে আবার নতুন করে অশান্তির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে দাবি শান্তিপুর কলেজেরই টিএমসিপির একাংশের।
সোমবারের ঘটনা তারই প্রতিফলন বলে দাবি তাদের। সোমবার শান্তিপুর কলেজে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল মনোজেরা। এ দিনের বোমাবাজির ঘটনায় যারা জড়িত তারা সেই রক্তদান শিবিরে উপস্থিত ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। যদিও এই ঘটনার সঙ্গে তার অনুগামীরা জড়িত নয় বলেই দাবি করেছেন মনোজ।
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সোমেন মাহাতো বলেন, ‘‘কলেজে ছাত্র ভর্তির টাকার ভাগ ও ছাত্র সংসদের দখল নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর গণ্ডগোলে বার বার উত্তপ্ত হয়েছে শহর। আবার শুরু হল। কলেজটা এখন বহিরাগত মস্তানদের দখলে।’’
এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে স্থানীয় বিধায়ক তথা শান্তিপুর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অজয় দে বলেন, ‘‘শান্তিপুরকে কেউ অশান্ত করার চেষ্টা করলে আমরা তা বরদাস্ত করব না। আগেও করিনি। আমরা চাই প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করুক।’’