বন্‌ধ তুলতে পুলিশের সামনে মারধর, দুই জেলাতেই ভোগান্তি

জেলায় প্রশাসনিক সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন—‘বন্‌ধকে সমর্থন করবেন না।’ অনুরোধ করেছিলেন, দোকান-বাজার, স্কুল-কলেজ খোলা রাখার। রাস্তায় বের হওয়া কোনও গাড়ির ক্ষতি হলে সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে—এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তারপরেও কৃষ্ণনগর-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবারের বন্‌ধে কমবেশি সাড়া মিলল। সিপিএম, বিজেপি-র দাবি, দুই জেলাতেই বন্‌ধ সর্বাত্মক হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৩:০৪
Share:

বন্‌ধ সমর্থকদের মারধর বহরমপুরে। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

জেলায় প্রশাসনিক সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন—‘বন্‌ধকে সমর্থন করবেন না।’ অনুরোধ করেছিলেন, দোকান-বাজার, স্কুল-কলেজ খোলা রাখার। রাস্তায় বের হওয়া কোনও গাড়ির ক্ষতি হলে সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে—এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তারপরেও কৃষ্ণনগর-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবারের বন্‌ধে কমবেশি সাড়া মিলল। সিপিএম, বিজেপি-র দাবি, দুই জেলাতেই বন্‌ধ সর্বাত্মক হয়েছে। পাশের জেলা বহরমপুরে আবার বন্‌ধের সমর্থনে পথে নামা সিপিএম নেতাদের পুলিশের সামনেই মারধরের অভিযোগ উঠল। বিক্ষিপ্ত অশান্তি হল কান্দি, বেলডাঙাতেও! সব মিলিয়ে আরও একটা কর্মনাশা বন্‌ধে বিস্তর ভোগান্তি পোহাতে হল সাধারণ মানুষকে।

Advertisement

বহরমপুরে তৃণমূল কর্মীদের হাতে প্রহৃত হলেন সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান মহিলা নেত্রী অনেকেই। সকাল ১০টা। জেলার কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে, টেক্সটাইল কলেজের সামনে, জেলা হেড পোস্ট অফিসে এবং মধুপুর বাজার মোড়ে সিপিএমের পক্ষ থেকে পিকেটিং চলছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ‘‘হঠাৎই তৃণমূলের দলবল লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করে এসে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে হামলা চালায়। পরে টেক্সটাইল কলেজের সামনে ও শেষে হেড পোস্ট অফিসের সামনে আক্রমণ হয়।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, ডিওয়াইএফের রাজ্য সভাপতি জামির মোল্লা, দলের জেলা কমিটির সদস্য শ্যাম দে, মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা সুলেখা চৌধুরী, টগর দে, সিটুর জেলা সম্পাদক তুষার দে-সহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। ৫ জন চিকিৎসাধীন।’’ মৃগাঙ্কবাবুর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন ও তাঁর ছেলে সৌমিকের নেতৃত্বে গুণ্ডা বাহিনী আচমকা চড়াও হয়। পেরেক গাঁথা লাঠি ও বাঁশ দিয়ে মারে।’’ সৌমিক যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘‘ওঁরা জোর করে অফিস বন্ধ করতে চাইছিল। প্রতিবাদ করলে আক্রমণ করে। আমরা প্রতিহত করেছি মাত্র।’’

পুলিশের সহায়তায় তৃণমূলের আক্রমণ প্রসঙ্গে জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।’’ তবে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে জেলা পুলিশের এক কর্তাকে সিপিএম নেতৃত্বের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘‘আপনাদের ৩৪ বছর সুযোগ করে দিয়েছি। এদের অন্তত ১০টি বছর সুযোগ দিন।’’ গোটা ঘটনায় সিপিএমের মোট ৬২ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শেখর সাহা ও জেলা কমিটির সদস্য সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

সদ্য সমাপ্ত পুরভোটেও মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের খারাপ ফল হয়েছে। ওই প্রসঙ্গ টেনে সিপিএম নেতা মইনুল হাসানের অভিযোগ, ‘‘জেলায় অস্তিত্বের সংকট থেকেই তৃণমূল পরিকল্পিত হামলা করেছে।’’ সিপিএম ও বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, বন্‌ধ সর্বাত্মক ও সফল। অন্য দিকে, তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি সাধারণ মানুষই আরও একটি কর্মশানা দিন রুখে দিয়েছেন। এ দিন জেলার প্রায় সব স্কুল কলেজ, অফিস আদালত খোলা ছিল। তবে কাজ সে ভাবে হয়নি। বেসরকারি বাস চলেনি। ট্রেন চলেছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুল কলেজে গেলেও পড়ুয়ারা যায়নি। সরকারি কার্যালয়ে কর্মী ও আধিকারিকরা গেলেও সাধারণ মানুষের ভিড় চোখ পড়েনি। দোকান, হাট বাজার ও ব্যাঙ্ক ছিল বন্ধ। ভগবানগোলা ও কান্দি থানা এলাকায় বনধ রুখতে বাইক বাহিনীর দাপট ছিল উল্লেখযোগ্য।

এ দিন গোলমাল হল কান্দিতেও। সকাল ন’টা নাগাদ বড়ঞা থানা এলাকার কান্দি-সাঁইথিয়া রাজ্য সড়কের কুলি মোড়ে রাস্তার পাশে মাইক নিয়ে বন্‌ধে মানুষকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। সেই সময়ে শাসক দলের কর্মীরা পুলিশের সামনেই সিপিএম নেতা, কর্মীদের বেধড়ক মারধর করে বলে অভিযোগ। জোর করে বন্‌ধ করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন সিপিএমের যুব সংগঠনের জেলা সম্পাদক ধ্রুব সাহা। একই ভাবে কান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৪ জন সিপিএম সমর্থককে গ্রেফতার করেছে কান্দির পুলিশ। সিপিএমের বড়ঞা জোনাল কমিটির সম্পাদক আনন্দ ঘোষ বলেন, “নেতা-কর্মীরা কোথাও বন্‌ধের জন্যে মানুষকে জোর করেননি। বন্‌ধ কেন, সেটাই মানুষকে বোঝানো হচ্ছিল। তা সফল হচ্ছে দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আমাদের উপরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।’’ এ দিন বেলডাঙাতেও অধিকাংশ বাজার ছিল বন্ধ। বাস কম চলেছে। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল কম। রাস্তায় বেরিয়ে যথেষ্ঠ গাড়ি না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়লেন সাধারণ মানুষ।

জঙ্গিপুরের রাস্তায় ভরসা ট্রাক। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

অন্য দিকে, বন্‌ধে নবদ্বীপে মিশ্র সাড়া মিলেছে। নদিয়ার অন্যতম এই বাণিজ্য কেন্দ্রে ব্যবসায়ীদের একাংশ দোকান খুললেও অনেকেই সে মুখো হননি। সকালে কিছু সময়ের জন্যে নবদ্বীপ-মায়াপুর খেয়া পারাপার বন্‌ধ ছিল। নবদ্বীপ বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু বাস চলেছে। তবে নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর রুটের কোনও বাস এ দিন চলেনি। স্কুল-কলেজর শিক্ষকেরা এলেও পড়ুয়াদের সে ভাবে দেখা যায়নি। আইনজীবীরা না আসায় নবদ্বীপ আদালতের কাজকর্ম হয়নি। নবদ্বীপের যে সব ব্যবসায়ীরা দোকান খুলেছিলেন, তারা জানিয়েছেন এ দিন কেনার লোক বিশেষ ছিল না!

মিশ্র সাড়া মিলেছে কল্যাণী, হরিণঘাটা, চাকদহ, ধানতলা, গাংনাপুর, তাহেরপুর এবং রানাঘাটে। এ দিন কিছু ট্রেন, বাস চললেও যাত্রী ছিল কম। অধিকাংশ সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। এ দিন সকালে ধানতলার পানিখালি মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে বিজেপি-র কর্মী, সমর্থকেরা। এর ফলে রানাঘাট-কৃষ্ণনগর ভায়া দত্তফুলিয়া রাস্তায় কিছুক্ষণ গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশ অবরোধ তোলে। এলাকার বন্ধের সমর্থনে মোটর বাইক র‍্যালি করে ওই সব এলাকার বিজেপি কর্মী, সমর্থকেরা। বিজেপি-র রানাঘাট ২ ব্লকের সভাপতি অশোক বিশ্বাসের দাবি, ‘‘বন্‌ধ সফল।’’ রানাঘাট আদালতে ঢোকার চেষ্টা করলে কয়েক জন আইনজীবীর পথ আটকায় বন্ধের সমর্থকেরা। বাজার খোলা থাকলেও সেখানে লোক ছিল হাতেগোনা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক খোলা থাকলেও কর্মী ও গ্রাহকদের উপস্থিতি ছিল কম। অধিকাংশ সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দিন সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়। দুপুর বারোটা থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এগারোটা থেকেই পরীক্ষার্থীদের আসতে দেখা গিয়েছে। একই ছবি ছিল বেসরকারি আইন কলেজগুলোতেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সমূহের নিয়ামক সুভাষ চক্রবর্তী জানিয়েছেন পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি। মোহনপুর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও বন্ধের তেমন প্রভাব পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ দিনও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল স্বাভাবিক। পঠনপাঠন, গবেষণা সব কাজই হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন