সেই ছিল ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা, ওরা আর আসেনি

এগরোলের সঙ্গে পায়েস মেলেনি। উৎসবের দিনে তাই চোখের জলে জোয়ার। নোনা জলে ভেসে যায় মেদিনীপুরের দহিজুড়ি থেকে যশোরের দইদিহা।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০১:০০
Share:

এগরোলের সঙ্গে পায়েস মেলেনি। উৎসবের দিনে তাই চোখের জলে জোয়ার। নোনা জলে ভেসে যায় মেদিনীপুরের দহিজুড়ি থেকে যশোরের দইদিহা। মন্দিরের পিছনের খুপরি ঘরগুলোর দরজা বন্ধ করে ওঁরা ঠেকিয়ে রাখেন বোধনের ঢাকের আওয়াজ, অষ্টমীর অঞ্জলি মন্ত্র। নাটমন্দিরের খোলা চাতালের কোণে ওঁদের জড়সড় ঘরবসতের কাছে এসে থমকে যায় দশমীর সিঁদুর খেলার কোলাহল।

Advertisement

সেই সে বার রথের দিন সকাল থেকে ঢাক বাজছিল দহিজুড়ির রথতলায়। নাতি-নাতনিদের লোকটা কথা দিয়েছিল জমি থেকে ফিরে বিকেলে রথ টানতে যাবে। দুপুরে মাঠ থেকে ফিরে ছিল লোকটার নিথর দেহ। বিকেলে যখন রথতলার রথের রশিতে টান পড়ল, ঢাক বেজে উঠল। তখনই লোকটা চিরকালের মতো ঘর ছেড়ে চলে গেল। সেই থেকে আনন্দীবালার মন খারাপ। কয়েক মাস পরেই ঝুলনের সময় ছেলেরা বলেছিল নবদ্বীপে চলো। তীর্থস্থান মন ভাল হবে। সবাই মিলে মেদিনীপুর থেকে সোজা নবদ্বীপ। শুনে ভারী ভালো লেগেছিল। গৌর, গঙ্গা, কীর্তণ। আহা আর কি চাই।

ছেলেরা ভারি ভালো আনন্দীবালার। মায়ের জন্য তড়িঘড়ি গঙ্গার ধারের আশ্রমে ঘরভাড়া নিয়ে মাকে বলেছিল, এখানে থাকো কিছুদিন। তারপর আমরা এসে বাড়ি নিয়ে যাবো। ঝুলনের কটাদিন একসঙ্গে কাটিয়ে সকলে ফিরে গেল। ছেলেদের সঙ্গে আনন্দীবালার সেটাই শেষ দেখা। ওরা আর আসেনি। পড়ে জেনেছেন আশ্রমের মোহান্তকে কয়েকমাসের ঘর ভাড়ার টাকা দিয়ে গেলেও ছেলেরা বাড়ির ঠিকানাটা ভুল দিয়েছিল। বিয়াল্লিশ বছর স্বামীর ঘর করে আসা আনন্দীবালার মনে ছিল, কিন্তু তিনিও চাননি ঠিকানাটা মনে করতে। তারপর থেকে আশ্রমের এক চিলতে ঘরেই তাঁর সংসার। তাও প্রায় বছর আটেক হয়ে গেল। আশ্রমের কাজ করে খাওয়া জোটে। “এখন আর মনটন খারাপ করে না” বলতে গিয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। জানেন স্বামী মারা যাওয়া দু মাসের মাথায় ছেলেরা আমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও পাইনি। অথচ সংসারে কোনদিন অশান্তি হয়নি। দুই ছেলে বউমা নাতিপুতি নিয়ে সাজানো ছিল সবকিছু। কিন্তু... উৎসবের দিন এলে কত কথা মনে পড়ে আনন্দীবালার। পুরানো কথা নাড়াচাড়া করতে করতেই কোথা দিয়ে যেন পুজো কেটে যায়।

Advertisement

নবদ্বীপের মঠমন্দির কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে এমন আনন্দীবালা অনেক। কেউ আছেন দশ বছর তো কারুর এ বার ঘরছাড়া হওয়ার পর এবারই প্রথম পুজো। যেমন শ্রদ্ধানন্দ পার্কের গোপাল মিত্র। কোনরকম রাখাঢাক না করে নিজেই জানালেন, “এ বারই প্রথম। কিছুতেই ওঁদের সঙ্গে মিলছিল না। ছেলেমেয়ে জামাই বউমা কারুর সঙ্গেই না। অথচ যত দিন ওঁদের মা বেঁচে ছিল, কোনও অসুবিধা হয়নি। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখছিলাম। শুধু কাজ করার জন্যই যেন আমার থাকা। জীবনযাপনটা ওঁদের জন্য। তাই সবছেড়ে নিজেই চলে এসেছি। বেশ আছি।” পুজোর দিনগুলোতে একা লাগবে না? “প্রতিবারই একা থাকি ওরা বেড়াতে যেত। আমি ফ্ল্যাট পাহারা দিতাম। এ বার বরং মণ্ডপে ঘুরে বেড়াবো।” তা হলে কারোর জন্য মন খারাপ, কথা শেষ হওয়ার আগে একটা ছোট গীতা এগিয়ে দিলেন গোপাল বাবু। “আসার সময় নাতিটা এটা কোথা থেকে এনে হাতে দিয়ে একছুটে পালিয়ে গেল।” ভাঙতে থাকেন শক্তপোক্ত মানুষটা। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন “এগরোলের সঙ্গে কি আর পায়েস মেলে।”

যশোরের দইদিহা গ্রামের সম্পন্ন ঘরের বউ ছিলেন শোভা সাহা। দেশভাগের আগে থেকেই এপারেও স্বামী শ্বশুরের জমিজিরেত ছিল। পাঁচ ছেলে দু মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। দুই ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর মারা গেলেন স্বামী। বউমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন শোভা দেবী। নিজের সন্তানরা দেখলাম বউদের পাশেই দাঁড়ালো। কেমন যেন অসহায় লাগছিল। একবার গাঁয়ে কীর্তনের দল গেল নবদ্বীপ থেকে। সেই কীর্তন শুনতে যাওয়া নিয়ে বাড়িতে তুমুল অশান্তি। ভোরবেলায় ঘর ছেড়ে ওঁদের সঙ্গেই নবদ্বীপ চলে আসি। তারপর থেকেই আছই। “ খুব ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল। সংসার ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। এসব বোধহয় তারই পরিণতি। ” করুণ হেসে বলেন শোভা দেবী। বলেন “আমাদের বাড়িতে একটা নিয়ম ছিল ষষ্টীর দিনে বাড়ির সবাই মিলে দুর্গা দর্শন। খুব আনন্দ হত।” ঘরের দেওয়ালে একটা ছেঁড়া ক্যালন্ডার। সপরিবার দুর্গা। বলেন “ওতেই এখন দেবী দর্শন করি। প্রতিমার মুখ আর দেখিনা।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement