ধর্মের নামে ভেন্ন মিডডে’র পাত

এক চিলতে সেই রান্নাঘরের মতোই সরু এক ফালি ফল্গু নদী দু’টো আটপৌরে গ্রামের বুক চিরে যেন ভেন্ন করেছে রামডোবা আর বসন্তপুরকে।

Advertisement

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:১০
Share:

লম্বাটে ঘরের দুই কোণে গনগন করে জ্বলছে দু’টো আধ-ভাঙা মাটির উনুন। ডাল নেমে গিয়েছে। এ-ওর গায়ে মাথা কুটে গবগব করে ফুটছে আলুপটলের টুকরো।জানলার মুখোমুখি অন্য উনুনে ডেকচিতে তখন আলু-সয়াবিনের ট্যালট্যালে ঝোলে সবে হলুদ পড়েছে।

Advertisement

এক চিলতে সেই রান্নাঘরের মতোই সরু এক ফালি ফল্গু নদী দু’টো আটপৌরে গ্রামের বুক চিরে যেন ভেন্ন করেছে রামডোবা আর বসন্তপুরকে।

রামডোবার মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পোশাক-পঠন এক হলেও মিডডে’র রান্না হচ্ছে আলাদা, পাত পড়ছে স্বতন্ত্র, ছেলে-মেয়েদের ক্লাস ঘরের বেঞ্চ হয়েছে ভিন্ন— শিক্ষাঙ্গনে ধর্মীয় অনুশাসনের এমন ছায়া পড়ায় লজ্জা মাথা নিচু করছেন স্থানীয় আহিরণ পঞ্চায়েতের বিজেপি প্রধানও। বলছেন, ‘‘এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। পাশাপাশি গ্রাম, হাত বাড়ালেই এ-ওকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে, সেখানে ধর্মের নামে এমন বিভেদের কী প্রয়োজন ছিল!’’

Advertisement

ধর্মের ছায়ায় বসন্তপুর-রামডোবার এই বৈরিতা অবশ্য নতুন নয়। রামডোবা গ্রামটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস। নদীর ও পারে, বসন্তপুর হিন্দু ধানক সম্প্রদায়ের পুরনো বসত। দু’গ্রামের মাঝে একটা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। সেটি পার হয়েই বসন্তপুরের পড়ুয়ারা এ গ্রামের স্কুলে আসে প্রতি দিন। তেমন বিবাদ-সংঘাতেরও খবর নেই। তবে স্কুলে ভাতের থালা বরাবর ভিন্ন।

স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক অসীম দাস বলছেন, ‘‘এ বিভাজন বহু পুরনো। চেষ্টা কম হয়নি। এক সময়ে শিক্ষকেরা নিজেরাই রান্না করে বিভেদ ভোলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফল মেলেনি।’’

অন্য এক শিক্ষক দীপক দাস বলছেন, “সব চেয়ে খারাপ লাগে কী জানেন, অভিভাবকের মনোভাবে বিষিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট পড়ুয়াদের মন!’’

অথচ স্কুল গড়ে ওঠার পরে এমন উনুন আলাদা হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের হিসেব বলছে, ২০১০ সালে এ ব্যাপারে আচমকা আপত্তি তোলেন বসন্তপুরের গ্রামবাসীদের একাংশ।

আপত্তি গ্রাহ্য না হওয়ায় সে গ্রামের পড়ুয়ারা মিডডে মিল খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল। দাবি, স্বজাতের রাঁধুনি দিয়ে রান্না করাতে হবে। প্রায় দেড় বছর ধরে সেই ‘গোঁ’ ধরে থাকার পরে শেষতক স্থানীয় বিডিও-র উদ্যোগে দু’গ্রামের মাতব্বরদের ডেকে বৈঠক হয়। কিন্তু লাভ হয়নি।

স্কুল শিক্ষা দফতর আর ঘাঁটাতে চায়নি। রান্নার জন্য হাঁড়ি আলাদা হয়ে যায় স্কুলের। স্বধর্মের রাঁধুনি দিয়ে শুরু হয় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৩২৯ জন ছাত্রছাত্রীর মিডডে মিলের রান্না।

এলাকাটি মন্ত্রী জাকির হোসেনের বিধানসভা এলাকায় পড়ে। জাকির বলছেন, ‘‘ বড্ড খারাপ লাগে। তবে, বিডিও-র সঙ্গে কথা বলে এর একটা বিহিত করতেই হবে।’’

ফিতের মতো ফল্গু চুপচাপ বয়ে যায়। নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে চুপচাপ চলে চলাচল। শুধু এক সঙ্গে মিডডে’র পাত পড়ে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement