আনুষ্ঠানিক ভাবে অবসর গ্রহণ করেছেন তিনি। তবু পর দিন সাত সকালে তিনি হাজির তাঁর নিজের হাতে গড়া জিয়াগঞ্জের মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জলের সঙ্গে মাছের মতো ওই বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাড়ুগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘স্কুল ছাড়লে দমবন্ধ হয়ে যাবে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চাই। অবসর তো সরকারি খাতা কলমে।’’
ছাত্রছাত্রীদের অবস্থাও একই রকম। সহকর্মী থেকে খুদে পড়ুয়া এমনকী অভিভাবকদের কাছেও নাড়ুবাবুর অবসরগ্রহণ ‘মাতৃপিতৃ বিয়োগের সামিল’। অবসরগ্রহণের অনুষ্ঠানে সে কথাই ব্যক্ত করেন তাঁরা। অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়া ছাড়াও সহকারি ও অবর মিলিয়ে শিক্ষা দফতরের মোট ৮ জন পরিদর্শক, এলাকার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবক-অভিভাবিকারা। নাড়ুবাবুর বিদায় বেলায় তাঁদের দেওয়া উপহার সামগ্রীর পরিমাণ এতটাই যে দু’দুটো টুকটুক উপচে পড়ে।
জিয়াগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মী তথা অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষক সমীর ঘোষ বলেন, ‘‘এক সময় তিনি বিড়ি বেঁধে পেটের ভাত জোগাড় করেছেন। আবার তিনিই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের সম্মান গ্রহণ করে জিয়াগঞ্জের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।’’
দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে উরঘুনাথগঞ্জের গণকরের উদ্বাস্তু শিবিরে এসে উঠেছিলেন। সেখানে লেখাপড়ার পাশাপশি পেটের খিদে মেটাতে রাতে কুপির আলোয় বিড়ি বাঁধতেন তিনি। এক সময় পেটের টানে গণকর থেকে জিয়াগঞ্জে চলে যেতে হয় তাঁকে। বিএ তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দিয়েই ছাড়তে হয় কলেজ।
অবশেষে ১৯৭৩ সালে কয়েক জন শিক্ষিত যুবককে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি অনুমোদন মেলে ১৯৮০ সালে। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন। তাঁর সহধর্মিনী মঞ্জুদেবীও ওই বিদ্যালেয়ের শিক্ষিকা। সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী শুরু করে দেন আদর্শ বিদ্যলয় গড়ার কাজ। স্থানীয় সমাজকর্মী হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‘১৯৯১ সালে দেখেছি একটি টিনের চালার ছোট্ট একটি ঘরের স্কুলবাড়ি। আজ সেই বাড়ি তিনতলা হয়েছে। ৩৫৯ জন খুদে পড়ুয়ার কলতানে মুখরিত। শিক্ষক দম্পতির দানে স্কুলে আজ পাঁচটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, স্কুলের নিজস্ব ওয়েবসাইট, কম্পিউটার, স্কুলের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি, মিড-ডে-মিলের রাঁধুনিদের অ্যাপ্রোন-দস্তানা।’’
শিক্ষক-শিক্ষিকারা মিলে গড়ে তুলেছেন বিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রকল্প। নিজের খরচে বছরে ৩-৪ বার পড়ুয়া ও তাদের বাবা-মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান তিনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দুর্গাপুজোর সময় দুঃস্থ পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেন নতুন পোশাক। বিদ্যালয়ের সব শিশুর নামে রয়েছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। নাড়ুবাবুর প্রচেষ্টায় সংখ্যালঘু পরিবারের পড়ুায়াদের জন্য বছরে বছরে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা অনুদান মেলে।
জমির অভাবে ৩৩ বছর ধরে আজিমগঞ্জের বারোদুয়ারি এলাকার ওই বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন জোটেনি। ছেলের অকাল মৃত্যুর কয়েক মাস পর ওই শিক্ষক দম্পতি ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকায় ৪ কাঠা জমি কিনে দিলে গড়ে ওঠে ‘দীপন চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’র পাকা ঘর। তাঁর স্বপ্নের মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মকুটে জুটেছে জেলার আদর্শ বিদ্যালয়ের দু’বারের পালক। এক বার হয়েছে জেলার নির্মল বিদ্যালয়। গত বছর ওই বিদ্যালয় অর্জন করে রাজ্যের ‘শিশুমিত্র’ মুকুট। নাড়ুবাবু ২০১১ সালে জেলার ‘কৃতী শিক্ষক’, ২০১২ সালে রাজ্যের ‘শিক্ষারত্ন’ অর্জন করেন। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে তুলে দেন ‘জাতীয় শিক্ষক’-এর সম্মান।
জেলার সহকারি বিদ্যালেয় পরিদর্শক সুশান্তকুমার দাস বলেন, ‘‘নাড়ুবাবু শিক্ষক সমাজের গর্ব।’’
আনুষ্ঠানিক অবসর পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু স্কুলের আঙিনা আর পড়ুয়াদের মন থেকে এমন শিক্ষকের ছুটি মেলে কই!