গজগজ করেই যাচ্ছিলেন যুবক।
—“এ ভাবে হয় নাকি। আর মাত্র ক’টা দিন বাকি। হঠাৎ করে এসে কি না বলে, বায়না বাতিল। মামার বাড়ির আবদার...।”
কৃষ্ণনগরে ফুলের ব্যবসা নারায়ণ সাহার। বড় ব্যবসায়ী। পোস্ট অফিস মোড়ে তাঁর দোকান। বরাবরই বছরের এই সময়টা দম ফেলার জো থাকে না। বিয়ের মরশুম বলে কি না কথা। ফুলের অর্ডার নেওয়া, সেই মতো মহাজনদের অর্ডার দেওয়া। সেই সঙ্গে খুচরো বিক্রিও আছে।
কিন্তু এ বছর... সব ওলোট-পালোট হয়ে গিয়েছে। বিক্রিবাট্টার বদলে ফুলের বায়না বাতিলের ধাক্কায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। আর নতুন করে যে ক’টা বায়না হচ্ছে, তা-ও ওই নামমাত্র।
এমনই এক খদ্দেরকে দেখে প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন নারায়ণ। —‘‘এমন দুমদাম বললেই হল। বায়না বাতিল! আমাদের চলবে কী করে?’’ কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রলোক। প্রশ্নের গুঁতোয় মুখ খুললেন এ বার। — ‘‘ঠিক আছে, তা হলে পাঁচশো-হাজারের নোট দিচ্ছি, নিয়ে নিন।’’
কথা আর বাড়েনি। সেটা করতে যে তিনি একেবারেই অপারগ, জানিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণ। পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে ভদ্রলোক জানান, তিনিও অপারগ হয়েই এসেছেন। বাধ্য
হয়েই ফুলের বাজেট কমাতে হয়েছে। এক রকম নমো নমো করে সারতে হচ্ছে সবটা।
কারণটাও ওই ‘নমো’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণা। আর তার পর থেকেই মাথায় হাত ব্যবসায়ী কী বর কিংবা কনে-কর্তার। নোটের গুঁতোয় বিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। নোটের ধাক্কায় নাতির বিয়েই পিছিয়ে দিয়েছেন গোলাম রসুল হালসানা। আর যাঁরা সেটা করেননি বা করতে পারেননি, বাজেটেই যতটা সম্ভব কাটছাট করছেন তাঁরা। যেমন, ওই ভদ্রলোক। চোদ্দো হাজার টাকার ফুলের অর্ডার দিয়েছিলেন। বুধবার সকালে এসে সেটা এক ধাক্কায় কমিয়ে গেলেন চার হাজারে।
শুধু কৃষ্ণনগরই নয়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় একই অভিজ্ঞতা ফুল ব্যবসায়ীদের। বিয়ের কেনাকাটা কিংবা মেনুতে না পেরে আনুষঙ্গিক জিনিসেই খরচ কিছুটা কমানোর চেষ্টা মাত্র।
আগামী সোমবার বিয়ে মাজদিয়ার বাসিন্দা গোপাল সাধুখাঁর। পাঁচশো-হাজারের ধাক্কা সামলাতে তিনিও ফুলের বাজেট খানিক কমিয়েছেন। বললেন, “সাধ থাকলেই কী আর সাধ্য থাকে? নিমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। খাওয়া খরচ তো আর কমাতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়েই...।”
এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ফুল চাষিদের উপরেও। এমনিতেই ফুলের ব্যবসা প্রায় পুরোটাই চলছে ধার-বাকিতে। তার উপর বিয়ের মরশুমেও এমন প্রভাব পড়লে চাষিদের
কপালে যে দুঃখ রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কারোরই। ফুল উৎপাদনকারী জেলাগুলির অন্যতম নদিয়া। আর এর উপর নির্ভর করে থাকে মুর্শিদবাদ-সহ আশপাশের সব জেলা। নদিয়ার রানাঘাট ২ নম্বর ব্লকের নোকারি, ধানতলা, দত্তফুলিয়া, আড়ংঘাটা, হিজুলি, মাঠকুমড়া, ঘোলা-সহ বিভিন্ন জায়গায় ফুল চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন
হাজার হাজার মানুষ। বলা যায়, শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ এই চাষের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সকলেই প্রায় তাকিয়ে থাকেন এই বিয়ের মরসুমটার দিকে। সেই মরশুমেই যে কী হতে চলেছে, তা টের পেতে শুরু করেছেন অনেকেই।
নদিয়া জেলার মধ্যে অন্যতম বড় ফুলের বাজার নোকারিতে।
সেখান থেকে ফুলবোঝাই ঝুরি চলে আসে রানাঘাট বাসস্টান্ডে। সেখান থেকে বাসের মাথায় করে উত্তরবঙ্গে। প্রতি দিনের এই চিত্রের কোনও পরিবর্তন হয়নি। বদলেছে শুধু ব্যবসায়িক লেনদেন পদ্ধতির। পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট নিয়ে সমস্যা হওয়ায় ধার-বাকিতে চলছে ব্যবসা।
আগামি ২১ নভেম্বর থেকে বিয়ের মরসুম শুরু হচ্ছে। ফুল ব্যবসায়ী নিতু সাহা বলেন, “এক প্রকার মুখের কথাতেই চলছে ব্যবসা। তার উপরে সামনে বিয়ের মরশুমেও অতিরিক্ত ফুলের অর্ডার আসছে না। এ বার সকলকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে হবে ব্যবসায়। জনি না, কী করে কী সামলাব?” একই কথা শুনিয়ে
আরেক ব্যবসায়ী প্রভাস জোয়াদ্দার বলেন, “কী বলব দাদা, টাকার সমস্যায় ফুল পাঠানোর গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত বাকি রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় নেই। না হলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।”
নোকারি বাজার ফুল ব্যাবসায়ী সমিতির সম্পাদক জ্যোতির্ময় মল্লিক বলেন, “বহু মানুষের রুজিরুটির ব্যাপার। ব্যবসা সচল রাখতেই হবে। অনেকেই তাই পুরানো পাঁচশো টাকার নোট নিচ্ছেন। কিন্তু বিয়ের মরশুমটা এ বার খুবই খারাপ যাবে। মানুষের টাকা আছে, কিন্তু কেনার উপায় নেই।”