পর্যাপ্ত শৌচালয় আছে তো?
পানীয় জলের ব্যবস্থা কেমন?
মিড-ডে মিলের খাবার স্বাস্থ্যকর?
স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বাচ্চারা কতটা সক্রিয়?
সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে পড়ুয়াদের উদ্ধাবনী ক্ষমতাই বা কতটা?
এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা। প্রশ্নপত্রে ছিল ছাত্রীদের ঋতুচক্রের বিষয়ে চেতনা বৃদ্ধি ও স্কুলের সহায়তা, মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরপর অন্তত ২ বছর শতকরা ১০০ ভাগ পরীক্ষার্থীর পাশ করার মতো বিষয়ও।
এ পরীক্ষা হয় প্রতিবছরই। কিন্তু গত চার বছরে বিজয়ী তালিকায় তো শহরের কোনও স্কুলের দেখা নেই! বরং তালিকায় উজ্জ্বল গ্রামীণ স্কুলগুলোরই নাম। গত ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক ৮টি ও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিকে ৩টি স্কুলকে শিক্ষামিত্র দেওয়া হয়েছে। সব ক’টি স্কুলই প্রত্যন্ত গ্রামে।
কিন্তু কেন?
দৃশ্য ১: যে কোনও সময় স্কুল প্রাঙ্গনে পা দিলে মনে হবে, এই মাত্র বুঝি ঝাড় দিয়ে সাফসুতরো করা হয়েছে। একটাও খড়কুটো খুঁজে পাওয়া যাবে না। লালগোলা থানার প্রত্যন্ত এলাকার লস্করপুর হাইস্কুলের মতোই ঝকঝকে তকতকে অবস্থা খড়গ্রাম থানা এলাকার ইন্দ্রানা হাসনা মায়ানি হাইস্কুল ও বহরমপুর শহর থেকে ১৮ কিলোমিটর দূরের তপসিলি অধ্যুসিত কোদলা বিজয়কৃষ্ণ আদর্শ বিদ্যামন্দিরের।
দৃশ্য ২: স্কুল প্রাঙ্গণে বা শ্রেণিকক্ষে রাখা আছে ‘ডাস্টবিন’। ক্লাসের মেঝে নোংরা করতে দেয় না খুদেরা।
দৃশ্য ৩: মিড ডে মিলের খাবার দেখভালে শিক্ষকদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে শিশু মন্ত্রিসভার সদস্যরাও। লস্করপুর হাইস্কুলের ৩ তলা ভবনের ৪২টি ঘরের দরজা, জানালা, আলো-পাখা বন্ধ করার দায়দায়িত্ব তুলে নিয়েছে তারাই।
দৃশ্য ৪: গত ক’বছর টানা মাধ্যমিক পরীক্ষায় শতকরা ১০০ ভাগ পড়ুয়া পাশ করেছে ওই ৩টি স্কুল থেকে।
এ ভাবেই পরীক্ষায় জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শহরের নামীদামি স্কুলগুলিকে টপকে গিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের ওই তিনটি স্কুল। ছিনিয়ে নিয়েছে শিশুমিত্র পুরস্কার।
ওই ৩টি হাইস্কুলের পাশাপাশি একই পুরস্কার অর্জন করেছে এ জেলার প্রান্তিক এলাকার ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। মোট ১১টি স্কুলের সব ক’টিই গ্রামীণ এলাকার। গত ৪ বছরে জেলার সদরশহর, মহকুমা বা পুরসভা এলাকার একটি একটি নামীদামি স্কুলও কেন এই সম্মান অর্জন করতে পারল না?
সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে সর্বশিক্ষা মিশনের মুর্শিদাবাদ জেলা আধিকারিক তানিয়া পারভিন বলেন, ‘‘শিশুমিত্র পাওয়ার বিষয়ে ক্রমশ সব স্কুলের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। সব স্কুলই যাতে শিশুমিত্র পায়, এমন পরিবেশ গড়ে তোলার কাজ চলছে।’’
জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পূরবী দে বিশ্বাস বলেন, ‘‘শিক্ষামিত্র পাওয়া প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ স্কুলগুলির সুন্দর পরিবেশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। এ রকম পরিবেশ শহরের স্কুলে নেই।’’
কেন নেই? পূরবীদেবী বলেন, ‘‘গ্রামের স্কুলের মতো মাঠ নেই শহরের স্কুলে।’’ কিন্তু জে এন অ্যাকাডেমি, মহারানি কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ স্কুলের মতো বহরমপুর শহরের নামীদামি স্কুলে তো মাঠ বা জায়গার অভাব নেই! তবুও সেখানে মি়ডডে মিল রান্না ও খাওয়া-সহ বিভিন্ন বিষয়ে আদর্শ পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি কেন? ‘হওয়া উচিৎ’— এ কথা বলেই দায় সেরেছেন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক পূরবীদেবী। মহারানি কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চৈতালি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এখনও হয়তো পরিকাঠামো তৈরি হয়নি বলে শহরের স্কুল সেই পুরস্কার পায় না। কে পায়, কেন পায় সেটাই ঠিক মতো বুঝি না।’’ কৃষ্ণনাথ কলেজে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাত্র মাস আটেক আগে গত ডিসেম্বরে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছি। এর মধ্যে সব কিছু আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’’
তবে শহরের শিক্ষকদের সম্পর্কে মোক্ষম কথাটি বলেন জেলাশিক্ষা বিভাগের এক কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘শহরের শিক্ষকদের একটি বড় অংশই স্কুলে আসা-যাওয়ার আগে টিউশন পড়াতে যান। ফলে অর্থের বদলে ‘শিশুমিত্র’ নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাঁদের!’’
রাজমিস্ত্রি ও শ্রমিক-প্রধান এলাকায় লস্করপুর হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক জাহাঙ্গির আলম কিংবা কামার-কুমোর ও গোয়ালা অধ্যুষিত কোদলা বিজয়কৃষ্ণবিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষক সুভাষ সিমলন্দি যা বললেন, তার সঙ্গে একমত হতদরিদ্র তপসিলি জাতি অধ্যুষিত ইন্দ্রানী হাসনা মায়ানী বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ তৌফিকুল ইসলাম। জানালেন, তাঁদের স্কুলের কৃতিত্বের একটাই রেসিপি। পৃথক ভাবে তাঁরা তিন জনেই বলেন, ‘‘১০টা-৫টা ডিউটির কেরানি বৃত্তির বাইরে বেরিয়ে শিশুদের আপন সন্তান মনে করতে হবে। তবেই না অন্তরের টানে পড়ুয়া স্কুলে আসবে। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই উদ্ভাবনী শক্তির জন্ম হবে। বিদ্যালয় তখন বিদ্যামন্দিরে রূপান্তরিত হবে।’’