ফেলে আসা পুঁইমাচা, নিকোনো উঠোন

তিন বছর আগের এক সকালে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিল সরস্বতী। একটা ট্রাক এক সাইকেল আরোহীকে পিষে দেয়। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে মানসিক ভারসাম্য খুইয়ে ফেলেছিল সে। পাড়ার লোকের কথায় ছেলে নিতাই তাকে এখানে রেখে দিয়ে যায়।

Advertisement

ছন্দক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:৩৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

লম্বাটে একটা হল ঘর। ইতিউতি ছড়িয়ে রংচটা কয়েকটা লোহার বেড। ঘরের পশ্চিম দিকের একটা জানলার ধারের একটা বেড তিন বছর ধরে ঠিকানা সরস্বতীর। বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের আবাসিক সরস্বতী মণ্ডলের আদি বাড়ি নদিয়ার চাকদহে। তিন বছর আগে বাড়ির লোক তাকে এখানে রেখে গিয়েছিল। তারপর সুস্থ হয়ে উঠলেও বাড়িতে ফেরা হয়নি ষাট ছুঁইছুঁই প্রৌঢ়ার। গত দু’বছরে তাকে দেখতে একটিবারের জন্যও কেউ আসেনি। আগে চাকদহের বাড়ির জন্য মনটা পাগল পাগল করত তার। ধীরে ধীরে অবুঝ মনকে সে বশে এনেছে। সরস্বতী বুঝে গিয়েছে, জীবনের শেষ ক’টা দিন এই হাসপাতালই তার ঘরবাড়ি।

Advertisement

তিন বছর আগের এক সকালে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিল সরস্বতী। একটা ট্রাক এক সাইকেল আরোহীকে পিষে দেয়। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে মানসিক ভারসাম্য খুইয়ে ফেলেছিল সে। পাড়ার লোকের কথায় ছেলে নিতাই তাকে এখানে রেখে দিয়ে যায়। প্রথম দিকে বউ-মেয়েকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে মাকে দেখতে বহরমপুরে আসত নিতাই। পরের দিকে ছেলে একা। আস্তে আস্তে সে-ও আসা কমিয়ে দিল। এখন আর নিতাইয়ের তার কথা মনে পড়ে না।

ছোট্ট নাতনিটার জন্য মাঝেমাঝে খুব কষ্ট হয় সরস্বতীর। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ তার কোলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াত একরত্তি মেয়েটা। সরস্বতী মনে মনে হিসেব কষল, এই তিন বছরে ও নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। দুপুরের পর অন্যরা যখন ঘুমোয়, তখন আস্তে আস্তে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সরস্বতী। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভাগীরথীর ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে আসে তার। চোখের সামনে জলছবির মতো ভেসে ওঠে চাকদহের বাড়ির নিকোনো উঠোন, পুঁইমাচা। নাতনি আর সে মিলে ওই পুঁইগাছটা বসিয়ে ছিল, বাড়ি ছাড়ার কিছুদিন আগে। পুঁই গাছটা কি এখনও আছে! ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে সরস্বতীর।

Advertisement

এই হাসপাতালে সরস্বতীর মতো আরও কয়েকজন আছে। সুস্থ হয়ে গেলেও ওদেরও বাড়ির লোক নিয়ে যায়নি। ওদের মধ্যে মৌসুমি বলে একটা মেয়ে সরস্বতীর খুব যত্নআত্তি করে। বিকেল হলে প্রতিদিন সে চিরুনি দিয়ে ‘মাসি’র চুল আঁচড়ে দেবে। তারপর রোদ একটু পড়লে ওরা একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করে। সরস্বতীর অবশ্য মনটা পড়ে থাকে চাকদহের বাড়িটায়। ছ’ বছরের নাতনিটা কি এখন ঘুম থেকে উঠেছে। বিকেল হলে ‘ঠাম্মা’র সঙ্গে প্রতিদিন বেড়াতে যাওয়া তার রুটিন ছিল। ‘আচ্ছা, এখনও কি বিকেল হলে নাতনি তাকে খোঁজে’, মনে মনে ভাবে সে! গঙ্গার ওপারে লাল হয়ে যাওয়া আকাশটায় ধীরে ধীরে আঁধার নামে। দূর থেকে ভেসে আসে স্টিমারের সাইরেন। টিভিতে এবার শুরু হবে ‘রানি রাসমণি’। চোখ মুছে ধীরে ধীরে সেদিকে পা বাড়ায় সরস্বতী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন