ছোটদের টোটো

আনপড় হাতে ধরা হ্যান্ডেল, বালাই নেই লাইসেন্সের। পদে পদে ঝুঁকি দুর্ঘটনার। ঘুরে দেখলেন কৌশিক সাহা ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস। ওরা কাজ করে... নেহাতই কাঁচা বয়স, তবু। চায়ের দোকানে, ইটভাটায়, কয়লার গোলায়। সুবোধ বালকদের সহজ পাঠে যা-ই লেখা থাক না কেন, চিরকালই করত। পেটের দায়ে। এখন টোটোও চালায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০১:০৪
Share:

ডোমকল

ওরা কাজ করে... নেহাতই কাঁচা বয়স, তবু।

Advertisement

চায়ের দোকানে, ইটভাটায়, কয়লার গোলায়। সুবোধ বালকদের সহজ পাঠে যা-ই লেখা থাক না কেন, চিরকালই করত। পেটের দায়ে। এখন টোটোও চালায়।

ছেলেটার বয়স বড় জোর ষোলো। যাত্রীর ধরার অপেক্ষায় কৃষ্ণনগর স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল টোটো নিয়ে। ট্রেন এসে থামতেই গলা উঁচিয়ে ডাকাডাকি করছিল প্যাসেঞ্জারদের। বুড়োধাড়িদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। শেষমেশ ভাতজাংলার জনা তিন প্যাসেঞ্জার টোটোয় চেপেও বসলেন। হ্যান্ডেল আঁকড়ে কিশোর হাত ছুটিয়ে দিল চাকা।

Advertisement

শুধু কি স্টেশনের কাছে? এ পাড়া-ও পাড়া, এ গলি-ও গলি এ রকম কত কচি ঘাসের মতো গোঁফ গজানো না-গজানো ক্ষুধার্ত মুখ। এক জন এ বছর সবে উচ্চ মাধ্যমিকের বেড়া টপকেছে। বাড়ি কৃষ্ণনগরের কুলগাছিতে। ‘‘এমনিতে বাবা বেরোন টোটো নিয়ে। বাবার শরীর খারাপ। তাই আমি বেরিয়েছি। রোজটা তো তুলতে হবে”— ম্লান হেসে বলে গাড়িতে স্টার্ট দেয় ছেলেটা।

কল্যাণীর সেন্ট্রাল পার্কের মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রায় একই কথা বলে আর একটি কচি-মুখ— “টোটো চালিয়ে কোনও রকমে আমাদের সংসার চলে। বাবা দুপুরের দিকে টোটো নিয়ে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেন। ওই সময়ে বাড়তি রোজগারের আশায় আমি টোটো নিয়ে রাস্তায় বেরোই।”

বহরমপুর থেকে বেলডাঙা, ডোমকল থেকে কান্দি— একটু নজর করলেই চোখে পড়বে এই সব মুখ, দশ থেকে ষোলোর। পোক্ত হয়নি সব হাত, সব সময় হ্যান্ডেল সামলে রাখতে পারে তা-ও নয়। এ দিক ও দিক ঠোকা লাগে। গালাগালি ছুটে আসে। মারতেও আসে কেউ-কেউ। যেমন কান্দি মহকুমা হাসপাতালের সামনে যেমন সাইকেলে চাকা ঠেকিয়ে দিয়েছিল বছর বারোর হাসন শেখ। কোনও মতে মারের হাত থেকে বেঁচে হাসনও বলে, “বাবা অসুস্থ। টোটো বাড়িতে বসে থাকবে, তাই একটু এসেছি।” লাইসেন্স আছে? টোটোর পিকআপ দিয়ে হাসন পাল্টা বলে, “আমরা তো ছোট, আমাদের কি লাইসেন্স দেয়!”

যদিও সব শহর বা শহরতলিরই লাইসেন্স পাওয়া টোটো চালকদের দাবি, বাবার অসুখ-টসুখ বাজে কথা! ছোটরাই নিয়মিত টোটো চালায়। বাবা অন্য কাজ করে। ছোট ছেলে দেখে প্যাসেঞ্জারের সহানুভূতি হয়। তাতে বেশি ভাড়া পায় ওরা। এটা আসলে একটা ছক। কিন্তু এতে বিপদের সম্ভাবনা প্রবল। প্রশাসন সব দেখেও চোখ বুজে আছে।

কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীমকুমার সাহার দাবি, “২০ বছরের কমবয়সী কাউকে পুরসভা টোটো চালানোর লাইসেন্স দেয় না। সে রকম কেউ যদি টোটো নিয়ে বেরোয়, পুলিশের দেখার কথা।” নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া কোনও মন্তব্য করতে চাননি। নদিয়ার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলেন, “টোটো চালানোর বিষয়টি এখনও আদালতে বিচারাধীন। এখনও পর্যন্ত পরিবহণ দফতর টোটো চালানোরই অনুমতি দেয়নি।”

মুর্শিদাবাদ জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, নির্দিষ্ট বয়সের নীচে টোটো চালানো আটকাতে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তা ও টোটো সংগঠনের লোকজনকে নিয়ে বহুবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তার পরেও অনেকে নিয়ম মানছে না। কান্দি ব্লক ও শহর ইলেট্রনিক্স রিকশা ইউনিয়নের সম্পাদক নুর আলম শেখের অভিযোগ, “শুধু এই শহরেই নিয়মিত ৬০-৭০ জন নাবালক টোটো চালায়। কিনতু কারও কোনও হেলদোল নেই।” জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক চিরন্তন প্রামাণিকের দাবি, “আমরা অভিযান চালাই। ভোটের সময়ে একটি ১৪ বছরের টোটো চালককে আমরা ধরেছিলাম। ফের পুলিশ-প্রশাসনের সাথে বৈঠক করব।”

প্রশাসন সক্রিয় হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে, নিশ্চিত। কিন্তু হ্যান্ডেল ছেড়ে কচি হাতগুলো মুখে ভাত তুলতে পারবে কি?

এই প্রশ্নটাও যে কাঁটার মতো খচখচ করে। করেই চলে।

ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম, সুদীপ ভট্টাচার্য ও গৌতম প্রামাণিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন