ডাক্তারের জন্য বন্দুকও বাগিয়ে ধরেন দালাল

সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে প্রাইভেট চেম্বার— ডাক্তারবাবুদের পিছু-পিছু ঘুরে বেড়ান ওঁরা। ব্যাগ বয়ে দেন, বিদেশ ভ্রমণের খরচও জোগান। রোগীর বাড়ির লোক উৎপাত করলে সামলে দেন তা-ও। বিনিময়ে মেলে প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের মোটা কমিশন। কী ভাবে কাজ করে এই চক্র? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।এক শ্রেণির চিকিৎসকের ছায়াসঙ্গী হয়ে নদিয়ায় অনেক ওষুধ সংস্থার দালালেরই আর্থিক অবস্থা কয়েক বছরের মধ্যে আমূল বদলে গিয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

এক শ্রেণির চিকিৎসকের ছায়াসঙ্গী হয়ে নদিয়ায় অনেক ওষুধ সংস্থার দালালেরই আর্থিক অবস্থা কয়েক বছরের মধ্যে আমূল বদলে গিয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

এঁদের অনেকেই বাড়ি-গাড়ি সব করে নিয়েছেন। অনেকেই পাড়ার পুজো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মোটা টাকা চাঁদা দেন। অর্থের সঙ্গে সামাজিক প্রতিপত্তিও বাড়ে এবং নামী চিকিৎসকের ‘কাছের লোক’ হওয়ার সুবাদে প্রশাসন, পুলিশ ও সমাজের উপরের স্তরের লোকেদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ তৈরি হয়। তাঁর কাছেই অনুরোধ আসে চিকিৎসকের কাছে দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইয়ে দেওয়ার। তার পরিবর্তে প্রভাবশালী অনেকের থেকে সুবিধা আদায় করেন সেই দালাল। তাঁদের ক্ষমতা দেখে অনেকেই ওষুধ সংস্থার দালালিতে আগ্রহ দেখান।

উল্টো দিকটাও আছে। ডাক্তারবাবু কখনও কোনও সমস্যায় পড়লে নিজের পরিচিত পুলিশ ও প্রশাসনের লোকেদের ধরে এই দালালেরা অনেক সময়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। হাসপাতালে হয়তো অত্যন্ত জরুরি কোনও ওষুধ অমিল, তা জোগাড় করে দেন। চিকিৎসকের অনুরোধে অনেক সময়ে রোগীর বাড়িতেও ওষুধ পৌঁছে দেন। আর ডাক্তারবাবুদের ফাইফরমাশ খেটে দেওয়া তো আছেই। ফলে এক শ্রেণির চিকিৎসক এঁদের পাশে রেখেই চলতে চান।

Advertisement

অতীতে এমনও একাধিক বার হয়েছে যে, সরকারি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহকারী সংস্থার দালালকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছেন চিকিৎসক! সেই দালাল-ই ঠিক করে দিয়েছেন কত টাকার স্টেন্ট বা পেসমেকার রোগীর শরীরে বসানো হবে। কখনও আবার আউটডোরে চিকিৎসকের পাশে বসে থেকেছেন দালাল। রোগী দেখার পর ওষুধ লিখে হাসপাতালের ফার্মেসিতে পাঠানোর বদলে ওই চিকিৎসক নির্দিষ্ট দালালকে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকেই ওষুধ নিতে বলছেন। রোগী ভয়ে বা ভক্তিতে চিকিৎসকের কথা অমান্য করতে পারেননি।

এই সুবিধার বিনিময়ে দালাল চিকিৎসকের ত্রাতা হয়ে উঠেছেন এমন নজিরও নদিয়ায় রয়েছে। কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালের কর্মীদের একাংশের দাবি, দালালদের কারও-কারও কাছে রাখা থাকে আগ্নেয়াস্ত্রও। বছর তিনেক আগে এক রোগীর মৃত্যুর পরে এক চিকিৎসকের উপরে চড়াও হয়েছিলেন রোগীর আত্মীয়-পরিজনেরা। সেই সময় ওই চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা এক ওষুধ সংস্থার দালাল কোমর থেকে বের করেছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। তাতেই ভিড় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনা দেখেছিলেন অনেকেই।

তার পরেও জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে দালালদের সখ্য নিয়ে ব্যবস্থা নেননি? কেন হাসপাতালে তাঁদের প্রবেশ আটকানো যায়নি?

কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালের সুপার শচীন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘‘আমরা জেনেছিলাম, এই রকম অবাঞ্ছিত কিছু লোক কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে থাকছেন। তখনই বিজ্ঞপ্তি জারি করে হাসপাতালে এঁদের প্রবেশ আটকানো হয়েছিল। সম্প্রতি আবার নতুন করে এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে।’’

কিন্তু তাতেও যে কাজ হয়নি তার প্রমাণ মিলেছে অতি সম্প্রতি। জেলা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসকের সঙ্গে প্রায় সব সময়ে তিন দালালকে দেখা যেত বলে হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্রের খবর। এঁদের মধ্যে এক জন সম্প্রতি ওই চিকিৎসকের বাড়ির সামনে খুন হন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, কোন সংস্থার ওষুধ চিকিৎসক বেশি লিখবেন তা নিয়ে দালালদের মধ্যে ঝামেলার সঙ্গে ওই খুনের যোগ থাকতে পারে। এই ঘটনায় পুলিশ ওই চিকিৎসকের সঙ্গী আর এক ওষুধ-দালালকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং তাতে জানা গিয়েছে, নিকট অতীতে একটি লুটের ঘটনায় ওই ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। চিকিৎসক সে খবর জানা সত্ত্বেও তাঁকে সঙ্গে করে চেম্বার থেকে হাসপাতাল, সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন। এতে তদন্তকারীরাও বেশ অবাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন