গদ্দার!
কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন নন্দিতা অরবিন্দ মোরারজি ওরফে অভিনেত্রী নাগমা।
এআইসিসি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তিনি, কম লোকই জানে।
“ইস বার য়ো গদ্দার কো মুহ তোড় জবাব দেনা চাহিয়ে!”
কথার ঝাঁঝে এক বার যেন কেঁপে উঠেছিল শান্তিপুরের ময়দান।
গদ্দার! কে? অজয় দে?
টানা পাঁচ বারের বিধায়ক তথা পুরপ্রধান অজয় দে-র উদ্দেশে কেউ এই শব্দ প্রয়োগ করতে পারে, হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি।
কিন্তু, আপত্তি তোলাও কঠিন।
আড়াই বছর তো হয়ে গেল। কংগ্রেসের বিধায়ক তথা পুরপ্রধান হিসেবে রজতজয়ন্তীর ঠিক আগে, ২০১৩-র নভেম্বরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেসের তদানীন্তন সহ-সভাপতি অজয় দে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তার পরেও উপ-নির্বাচনে জিতে তৃণমূল বিধায়ক এবং পুরপ্রধান হিসাবে বছর দুয়েক কাটানো হয়ে গেল তাঁর। ৩৪ বছরের বাম জমানায় যে শান্তিপুর ছিল কংগ্রসের শক্ত ঘাঁটি সেখানে এখন জোড়াফুলে ছয়লাপ। শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী ‘কংগ্রেস ভবন’ নাম পাল্টে রাতারাতি ‘তৃণমূল ভবন’ হয়ে গিয়েছে।
গত আড়াই দশক ধরে শান্তিপুরে অজয় দে আর কংগ্রেস সমার্থক হয়ে উঠেছিলো। সিপিএম জমানা গেল, তৃণমূলের ঝড় গেল, পালাবদলের বিন্দুমাত্র আঁচ তিনি লাগতে দেননি। ‘একা কুম্ভ’ হয়ে পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচন ও পুরভোটে কংগ্রেসেকে তিনি সম্মানের সঙ্গে উতরে দিয়েছেন। তাঁকে জেতানো শান্তিপুরের মানুষের এক রকম অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল।
সেই অভ্যাস কি বজায় থাকছে?
নাকি জোট হওয়ায় খেলাটা বদলে যেতে পারে?
কংগ্রেসের সাবেক দুর্গ শান্তিপুর কি ফিরে চাইতে পারে হাত চিহ্ন?
তৃণমূল প্রার্থী অজয় দে-র বিরোধী হিসেবে ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে পারে কি কংগ্রেসের অজয় দে’র ছায়া? আর তাঁর অজেয় কংগ্রেসের ‘মিথ’?
নিজস্ব ঢঙে সব নস্যাৎ করে দিয়ে অজয় দে বলছেন, “শান্তিপুরের সাধারণ মানুষ মনের থেকে আমাদের চান। পরিযায়ী পাখির মতো এক জন এসে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর অমনি ‘গেল গেল’ রব তুলতে হবে, এমন রাজনীতি আমি অন্তত করি না।’’
সত্যিই তো! দলবদলের পর উপ-নির্বাচন এবং পুরভোট দু’টোতেই হইহই করে জিতেছেন অজয় দে। কী করে? উত্তর: উন্নয়ন, উন্নয়ন, উন্নয়ন। বলছেন, ‘‘বিধায়কের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে নয়া পয়সা শান্তিপুর শহরে খরচ করিনি। পুরো টাকাটাই খরচ হয়েছে শান্তিপুর ব্লকে। শহরের জন্য পুরসভাই যথেষ্ট। এক বার গ্রামগুলো দেখে আসুন, যদি এমন গ্রাম পান যেখানে আমার নামের ফলক নেই, আমাকে বলবেন।’’
এতই যদি আত্মবিশ্বাস, কংগ্রেস প্রার্থীকে আক্রমণ করার দরকার হল কেন তৃণমূলের? তবে কি তারা হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে?
কংগ্রেস নেতা তথা একদা অজয়-ঘনিষ্ঠ কুমারেশ চক্রবর্তীর দাবি, “আরে, এ তো সহজ অঙ্ক। ২০১৪-র উপ-নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়ে অজয়বাবু পেয়েছিলেন ৭১ হাজার ভোট। কংগ্রেসের হয়ে আমি পাই প্রায় ৩৭ হাজার ভোট। সিপিএমের অনুপ ঘোষ পান ৫১ হাজার ভোট। বিজেপি পেয়েছিল ২৪ হাজার ভোট। কংগ্রেস আর সিপিএমের ভোট যোগ করেই দেখুন, অজয়বাবু কত ভোটে পিছিয়ে পড়ছেন। সঙ্গে যোগ করুন বিজেপির হাতছাড়া হওয়া ভোটের বড় একটা অংশ। কী বুঝলেন?”
জোটপ্রার্থী, প্রদেশ কংগ্রেসের যুব সভাপতি অরিন্দম ভট্টাচার্যের মতে, “শান্তিপুর এখনও কংগ্রেসকেই ভোট দিতে চায়। কোনও দিন কংগ্রেসেকে তারা ফেরায়নি। অজয়বাবু মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দল বদলে ফেলেছেন।” গত ভোটে তার কোনও প্রভাবই পড়ল না? অরিন্দমের দাবি, “কী ভাবে যোগ-বিয়োগ করলে বিরোধী ভোট ভাগ হবে, সেই অঙ্কটা এত দিন উনি একাই কষতেন। তাই জিততেন। গত পুরভোটে অপছন্দের তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধেও গোঁজ দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর খেলাটা আমরা ধরে ফেলেছি। শান্তিপুরের মানুষ এর জবাব দেবেন।”
সিপিএম তো মান-অভিমান ঝেড়ে ফেলে পুরোদস্তুর কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছেই। তৃণমূলের ঘরও যে পুরোপুরি অক্ষত, এমনটা নয়। একে তো অজয় দে দলে আসার পরে পুরনো নেতারা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছেন। অভিমান পাক খাচ্ছে অনেকেরই বুকপকেটে। তলায় তলায় দলের একাংশ জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, শোনা যাচ্ছে এমনটাও। নাগমার রোড-শোয়ে এক তৃণমূল কাউন্সিলারের ছেলেকে দেখা গিয়েছে বলেও খবর।
শান্তিপুর কার? অজয় দে-র নাকি অজেয় কংগ্রেসের?
কাল জানাবে শান্তিপুর।