থিম-পুজোকে টক্কর সাবেক মণ্ডপ শিল্পীদের

সে বার দুর্গাপুজোয় কাঁচরাপাড়া নবাঙ্কুর ক্লাবের মণ্ডপ দেখে তাক লেগে গেল সকলের। তখনও থিমের পুজোর কথা মানুষ জানত না। কাচ আর আয়না দিয়ে গড়া মণ্ডপের নাম ছিল ‘শিসমহল’।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০২:৪৯
Share:

সে বার দুর্গাপুজোয় কাঁচরাপাড়া নবাঙ্কুর ক্লাবের মণ্ডপ দেখে তাক লেগে গেল সকলের। তখনও থিমের পুজোর কথা মানুষ জানত না। কাচ আর আয়না দিয়ে গড়া মণ্ডপের নাম ছিল ‘শিসমহল’। কাচের তৈরি আশ্চর্য সেই মণ্ডপের কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় পুজোর ক’দিন ভিড় উপচে পড়েছিল নবাঙ্কুর ক্লাবে। আশপাশের এলাকা থেকে লোকে বাসে-ট্রেনে চেপে ‘শিসমহল’ দেখতে এসেছিল। লক্ষাধিক টাকার সেই মণ্ডপ তৈরি করে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যান অরুণ বিশ্বাস।

Advertisement

তার পর একটানা বেশ কয়েক বছর ধরে অরুণবাবুর ওই শিসমহল আলো করেছিল বারাসত থেকে বর্ধমানের বিভিন্ন উৎসব প্রাঙ্গণ। এমনকী ভিন্ রাজ্যের অমৃতসর থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত ওই মণ্ডপ নিয়ে ছুটেছেন অরুণবাবু। শিসমহল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এখনও খুশিতে ঝকঝক করে ওঠে প্রবীণ মণ্ডপ ব্যবসায়ীর চোখ।

কিন্তু সে সব আড়াই দশক আগের কথা। তার পর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। আমুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে উৎসবের উপলক্ষ থেকে আয়োজন, উৎসব ভাবনা থেকে অনুষ্ঠানের সংখ্যা সব কিছুতেই। আর বদলে যাওয়া সময়ে একটি মাত্র মণ্ডপ-ভাবনা নিয়ে নিশ্চিন্তে কয়েক বছর ধরে দেশ দাপিয়ে বেড়ানোর কথা ভাবতেই পারেন না আজকের মণ্ডপশিল্পীরা। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন ভাবনাকে উপস্থাপণ করাই আজকের মণ্ডপশিল্পীদের কাছে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে নিত্যনতুন উৎসব ঘিরে আয়োজক, উদ্যোক্তাদের নতুন নতুন চাহিদা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন মণ্ডপ নির্মাতারা। সরাসরি যার প্রভাব এসে পড়েছে আজকের মণ্ডপ শিল্পের উপর।

Advertisement

সম্প্রতি নবদ্বীপ শহরে দু’দিন ধরে চলা নদিয়া জেলা ডেকরেটার্স সমন্বয় সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে উঠে এল ডেকরেটার্স ব্যবসার নানা দিক নিয়ে এমনই সব কথা। সারা জেলা এবং রাজ্য থেকে প্রায় আটশো প্রতিনিধি দু’দিনের এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। সাবেক মণ্ডপশিল্পকে কী ভাবে সময়োপযোগী করে তোলা যায়, সেই নিয়ে প্রতিনিধিরা মত বিনিময় করেন।

মণ্ডপনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন একটা সময়ে যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানেই সবার আগে তাঁদের ডাক পড়ত। তা সে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হোক, ছোট-বড় পুজোপার্বন, কিংবা বিয়ে, অন্নপ্রাশন। কিন্তু আজ ছবিটা অনেকটাই অন্য রকম। বিয়ে-পৈতের মতো সামজিক অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ এখন ভাড়া করা উৎসব বাড়িতে হয়। অন্য দিকে দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো অনুষ্ঠানে জাঁকিয়ে বসেছে থিম। ফলে শহরাঞ্চলে জোরালো প্রতিযোগিতার মুখে মণ্ডপনির্মাণ শিল্প। বাঁশ, ত্রিপল আর রঙিন সামিয়ানার সাবেকি ধ্যানধারণার উপর নির্ভর করলে যে চলবে না, সেটা ভাল ভাবেই বুঝেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে নতুন ভাবনার উপরেই জোর দিচ্ছেন তাঁরা।

তবে কিছু সমস্যা রয়েছে। সে প্রসঙ্গে নদিয়া জেলা ডেকরেটার্স সমন্বয় সমিতির যুগ্ম সম্পাদকদের অন্যতম বিপ্লব চন্দ বলেন, মণ্ডপনির্মাণ শিল্পের সঙ্গে কয়েক লক্ষ মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন জড়িত। কেবলমাত্র নদিয়া জেলায় মণ্ডপনির্মান ব্যবসায় প্রায় ১৭০০ মালিক রয়েছেন। আমাদের সংগঠনের বাইরেও অনেকে আছেন। তাঁদের প্রত্যেকের অধীনে কমপক্ষে দশ-বারো জন করে শ্রমিক আছেন। গোটা রাজ্যের নিরিখে শ্রমিক-মালিক মিলিয়ে সংখ্যাটা সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন, “অথচ এই মণ্ডপনির্মাণ আজও শিল্পের মর্যাদা পায়নি। ফলে কর্মীরা স্বাস্থ্য থেকে বিমা কোনও সুযোগ-সুবিধাই পান না। ব্যবসার জন্য আমাদের ঋণ দেয় না ব্যাঙ্ক। এই সম্মেলন থেকে আমরা সেই মর্যাদা সবার আগে দাবি করছি।”

সমিতির সভাপতি অরুণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘আজকের দিনে সব চেয়ে বড় সমস্যা হল মানুষের রুচি এবং সঙ্গতি দু’টোই আমুল বদলে গিয়েছে। এক দিকে ‘অনুষ্ঠান হল’ বা ‘থিমের পুজোর’ জন্য হয়তো কাজ কিছু আমাদের কমেছে। পাশাপাশি মানুষের রুচির বদল হওয়ায় খুব ছোটখাটো কাজের জন্যও লোকে পয়সা খরচ করতে কার্পণ্য করছে না। বিয়ে তো বটেই সামান্য জন্মদিনে মণ্ডপ সাজাতে মানুষ যা খরচ করছেন, দশ বছর আগেও তা কল্পনা করতে পারতাম না। কিন্তু তাঁরা চাইছেন নতুনত্ব।

অরুণবাবু বলেন, “নিত্যনতুন আইডিয়াই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। কাঁসা-পিতল থেকে তাঁতের শাড়ি সব কিছুই এখন মণ্ডপের উপকরণ। ফলে যতই থিম আসুক, মণ্ডপনির্মাণের কোনও বিকল্প হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন