বিশ্বাসেই বুকিং, ভাড়া মেটাবেন পরে

সকাল ন’টা। নবদ্বীপ খেয়াঘাটের টোটো স্ট্যান্ডে থামল পর পর চারখানা টোটো। ঠাসা যাত্রী। বিপত্তিটা হল টোটোর ভাড়া দেওয়া নিয়ে।

Advertisement

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৪
Share:

ভিড়ে ঠাসা এমন চিত্র এখন উঠাও। —ফাইল চিত্র।

সকাল ন’টা। নবদ্বীপ খেয়াঘাটের টোটো স্ট্যান্ডে থামল পর পর চারখানা টোটো। ঠাসা যাত্রী। বিপত্তিটা হল টোটোর ভাড়া দেওয়া নিয়ে।

Advertisement

জয়নগর থেকে সপরিবারে নবদ্বীপে এসেছিলেন তপন বিশ্বাসের পরিবার। বুধবার সকাল থেকে ঘণ্টা কয়েক নবদ্বীপ ঘুরে নৌকা ধরে মায়াপুর যাওয়ার কথা। টোটো পিছু আড়াইশো টাকা করে রফা হয়েছিল। ভাড়া মেটাতে গিয়ে তপনবাবু দু’টো পাঁচশো টাকার নোট দিতেই বিপত্তি শুরু। পাঁচশো টাকা কিছুতেই নেবে না টোটো চালকেরা। নিরুপায় বিশ্বাস পরিবার বলছে, “আমরা বেড়াতে এসেছি। হাজার টাকার ভাড়া পাঁচশো টাকার নোট ছাড়া আর কী করে দেব বলুন তো?”

অনেকক্ষন ধরে বাদানুবাদের পর স্থানীয় যুবকদের হস্তক্ষেপে শেষ অবধি নিমরাজি হয়ে পাঁচশো টাকার নোট নিলেন টোটো চালকেরা। তবে তপনবাবুরা অবশ্য এই ঘটনার পর মায়াপুর যাননি, সোজা পিরে গিয়েছেন জয়নগর।

Advertisement

ছবিটা প্রায় একইরকম আশি কিলোমিটার দূরের বহরমপুরে।

লন্ডন থেকে ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ শহর বেড়াতে এসে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী বাঙালি রাজেশ্বরী মণ্ডল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বহরমপুর শহর লাগোয়া হরিদাসমাটি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলেন। বুধবার সকালে তাঁরা একটি গাড়ি করে লালবাগের হাজারদুয়ারি প্যালেস ও মিউজিয়াম দেখতে বের হয়ে বিপাকে পড়েন। রাজেশ্বরীদেবী বলেন, ‘‘আমার কাছে সবই ৫০০ টাকার নোট। সেই নোট কেউ নিতে চায়নি। ফলে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার মেলেনি। কিছু কেনাকাটা করার কথা ভেবেছিলাম। সে সবও আর সম্ভব
হল না।’’ বুধবার সকাল থেকেই নবদ্বীপ জুড়ে বহিরাগত পর্যটকদের সঙ্গে এমন ঘটনা আকছার। পর্যটনের উপর নির্ভরশীল নবদ্বীপের অর্থনীতি শহরের সবচেয়ে বড় উৎসব রাসের মুখে নোট বাতিলের ধাক্কায় রীতিমতো বেহাল। স্থানীয় বাজার থেকে খুচরো, পাইকারি ব্যবসা সব জায়াগাতেই বিভ্রান্তির এক শেষ।

নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “রাসের মতো বিরাট উৎসবের মুখে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বলা মুশকিল।”

রাসে নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত আসেন, রাত্রি বাস করেন। এ বার সেই জনসমাগম অনেকটাই কম হবে বলে মনে করছেন সকলে।

রাসের মুখে এ নিয়ে সমস্যায় নবদ্বীপের মঠমন্দির গুলিও। নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপের সব থেকে বড় উৎসবের ঠিক মুখে এমন একটা ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ফলে এখানকার সঙ্কট অন্যান্য জায়গার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা পেয়ে গেল।”

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমিতির সহ সভাপতি কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, “মঠমন্দিরে যারা আসেন তাঁরা কেউ কার্ড নিয়ে আসেন না। কেননা কার্ড দিয়ে পুজো, প্রনামী, প্রসাদ কিছুই কেনা যায় না। সবাই নগদ টাকাই দেন।”

যদিও বেঙ্গল হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকারের কথায়, “এখন আর কেউ নগদ টাকা পকেটে নিয়ে বেড়াতে আসে না। সবাই কার্ডের মাধ্যমে কাজ সারেন। সুতরাং সে সব ক্ষেত্রে কোন সমস্যাই হবে না।’’

এ সব নিয়ে অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই মায়াপুর ইস্কনে আসা পর্যটকদের। ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “আমাদের এখানে সমস্ত অতিথিশালায় ভিড় উপচে পড়েছে। নোট বাতিলে জন্য বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন বুকিং বাতিল হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঘরভাড়া বা খাওয়াদাওয়া বাবদ প্রাপ্য টাকা নগদে দিতে এলে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নেওয়া হবে না। কার্ড না থাকলে ঠিকানা লিখে রাখব, বিশ্বাসে ভরসা করা ছাড়া উপায় কী!’’”

মুর্শিদাবাদ স্টেশন লাগোয়া এক হোটেল মালিক ইন্দ্রজিৎ ধর বলেন, ‘‘এ রকম বিপাকে পড়া অনেকে পর্যটকের জন্যই ঘর ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাকদ্বীপের কমল দাস। বুধবার সকালে গাড়িতে কাকদ্বীপ থেকে হাজারদুয়ারি প্যালেসে পৌঁছে দেখেন একশোর নোট চলবে না। কমল বলেন, ‘‘অনেক অনুরোধে ঘর মিলেছে, ওঁরা বিশ্বাস করছেন বলেই অন্তত ঘরে ফিরে যেতে হল না।’’

লালবাগের এক হোটেল মালিকের কথায়, ‘‘নোটের ধাক্কায় পর্যটনেই পক্ষাঘাত বলতে পারেন!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement