সবেধন: ঘূর্ণী বেলতলা বাজারে এখন একটিই বুথ। নিজস্ব চিত্র
মোবাইলের ব্যবহার বাড়তে থাকায় শহরের দিকের বুথগুলি মোটামুটি সবই ২০০৯-২০১০ সালের আশেপাশে বন্ধ হতে শুরু করে। গ্রামের দিকের বুথগুলি তার পরেও কয়েক বছর চলেছিল। গ্রামের মানুষের হাতে মোবাইল চলে আসার পর আস্তে আস্তে সে সবও বন্ধ হয়ে যায়।
যেমন, ধুবুলিয়ার আনন্দনগরের শ্যামল সরকারের মুদিখানার দোকান। ২০১০-এ তিনি তাঁর মুদির দোকানের সঙ্গে ফোন বুথের ব্যবসাও শুরু করেন। সেই সময়ে আশেপাশের তিনটি গ্রামের মানুষ তাঁর টেলিফোন বুথের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। বুথের সামনে একটা বড় বাঁশের মাথায় একটা মাইক বাঁধা থাকত। দূর-দুরান্ত থেকে অনেকে গ্রামের কারও খোঁজ নিতে তাঁর বুথে এসেই ফোন করতেন।
তিনিও মাইকে ঘোষণা করে ডেকে আনতেন কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। প্রথম দিকে আয় ভাল হলেও বছর পাঁচেকের মধ্যেই সেই আয় তলানিতে এসে ঠেকে। ফলে, বুথ তুলে দিতে বাধ্য হন তিনি। তাঁর মুদি দোকানের পাশেই মোবাইল রিপেয়ারিং আর রিচার্জের দোকান তাঁর ভাইপোর। এখন তো আশেপাশের গ্রামগুলি মিলিয়ে মাসে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকার রিচার্জ হয় বলে জানান তাঁর ভাইপো। কিন্তু সেই টেলিফোন বুথের জমানাকে এখনও ভুলতে পারেননি তাঁরা। সব জায়গাতেই যখন টেলিফোন বুথ স্মৃতি হয়ে গিয়েছে, তখনও কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণী বেলতলা বাজারে সতেরো বছর ধরে বুথ আঁকড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ গড়াই।
‘‘এখন তো কালে-ভদ্রে দু’-এক জন আসেন ফোন করতে। মাসের শেষে ফোন ভাড়ার প্রায় পুরোটাই আমাদের ঘরের টাকা থেকেই দিতে হয়। কত বার ভেবেছি তুলে দেব। কিন্তু কত স্মৃতি জড়িয়ে এই বুথের সঙ্গে, তাই মন থেকে লাইন কাটতে পারি না।’’— বলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি জানান, বিলিং-এর যন্ত্র খারাপ। তা সারানোর লোক নেই। ঘড়িতে সময় দেখে আন্দাজে টাকা নেন কেউ ফোন করতে এলে। রিসিভার খারাপ হলে রিসিভার মেলে না।
‘‘জানি না আবেগকে আঁকড়ে ধরে কত দিন বাঁচাতে পারবো এই বুথ!" এসটিডি, আইএসডি, পিসিও লেখা কাঁচের ঘরটার পাশে টেবিলে বসে চোখ মুছতে মুছতে বলেন রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী উমারানি।
রাত তখন সাড়ে আটটা হবে। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে করতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে বলেন— ‘‘আজ আর কেউ আসবে বলে মনে হয় না। লাইটগুলি নিভিয়ে দাও।’’
অন্ধকারে থম মেরে থাকে ভাঙাচোরা টেলিফোন বুথ। (শেষ)