যেন ন্যাবা হয়েছে!
বরের গা হলুদ হয়ে আছে। সাত সধবার শিল-নোড়ায় বাটা হলুদ, বরের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে। সঙ্গে মিশেছে কনের বাড়িরটাও। এ বার মাটির সরা দিয়ে ঢাকা একটি কড়ি ও একটি গোটা হলুদ। সেই সরার পাশে রাখা হয়েছে একটি শিল। সেই শিলে পা দিয়ে সরার উপর গোড়ালি দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। ভেঙে যায় সরা। গায়ে হলুদের পর্ব হল শেষ। খানিক অতীত, খানিক স্মৃতি সে সব। কালো অঙ্গ হারিয়ে বর যেন অচেনা এক হলুদ মানুষ।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নানা রকমের গীত-বাদ্যির প্রচলন ছিল সে কালে। আসলে গায়ে হলুদ আর আইবুড়ো ভাত, অর্থাৎ থুবড়া খাওয়ার অনুষ্ঠান যেন মাতৃপক্ষের নবমী নিশি। তেমন একটি গীত, ‘‘তেলে হলুদে মেখে বালি (বালিকা) দাঁড়ালো সরানে/ হেন সময় রাজার ছেলে বালি হরিণ শিকারে যায়/ সীতার মানান সিঁদুর দেব বালি আমার মহালে আয়। তোমার মহালে গেলে রাজার ছেলে আমার মা পাব কোথায়/ লুকা লুকা বালি আজকের রাতখানিরে/ দৌড়ে দৌড়ে লুকা বেটি আপন মায়ের কোল। আর কি বিটিকে রাখা যায় মহলের ভিতর।’’
গায়ে হলুদ ও থুবড়া খাওয়ার অনুষ্ঠান একটি গীতের মধ্যে বিধৃত রয়েছে। ‘যখন ছেলে দামাদ তেল হলুদ মাখে তখনি ভাবের মেলেনি বাটি ধরে টানে/ টেনো না টেনো না মেলেনি আমার মাথার কি রে/ আগে করেছি খুশি পেছে আমার বিহে।। যখন ছেলে দামাদ গোসল করিতে খাড়ো তখনি ভাবের মেলেনি বাটি ধরে টানে/ টেনো না টেনো না মেলেনি আমার মাথার কিরে/ আগে করেছি খুশি পেছে আমার বিহে।। যখন ছেলে দামাদ কাপড় পরিতে খাড়ো তখনি ভাবের মেলেনি কাপড় ধরে টানে।। টেনো না টেনো না মেলেনি আমার মাথার কিরে/ আগে করেছি খুশি পেছে আমার বিহে।। যখন ছেলে দামাদ থুবড় খেতে বসে তখনি ভাবের মেলেনি বাটি ধরে টানে।। টেনো না টেনো না মেলেনি আমার মাথার কি রে/ আগে করেছি খুশি পেছে আমার বিহে।।’’
পাঁচ রকমের ভাজা, ডাল, মাছের মুড়ো, ক্ষীর, পাকোয়ান-সহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন দিয়ে আইবুড়ো ভাত, বা থুবড়া খাওয়ানো হয়। প্রথমে বয়ঃজ্যেষ্ঠের মুখে মিষ্টান্ন তুলে দেওয়াই ছিল রীতি। তার পরে অন্যরা। পাশে বসে পরিবারের কেউ খাতা পেন নিয়ে উপহার সামগ্রীর তালিকা লিখতে থাকেন। কারণ, পরবর্তীতে দাদার বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে একই রকম উপহার সামগ্রী দিতে হবে। তবে থুবড়া খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যায় বর ও কনে। সেই ক্লান্তির বর্ণনা উঠে এসেছে একটি গীতে।
খীরমি (ক্ষীর) খেতে লাগে গরমি,/ কতি গেলে আপন সোদর বহিন পাঙ্খা দুলাও রে।। খীরমি খেতে লাগে গরমি/ কতি গেলে আপন সোদর ভাইও পাঙ্খা দুলাও রে।। খীরমি খেতে লাগে গরমি/ কতি গেলে আপন ভাবী পাঙ্খা দুলাও রে। খীরমি খেতে লাগে গরমি/ কতি গেলে আপন মায়ো পাঙ্খা দুলাও রে।।’’