রাতের পথ ধরেই উড়ে আসে বিপদ

বহরমপুর স্টেশনের বছর বাইশের মেয়েটি আবার বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। মাঝেমধ্যেই ঘড়ি দেখছেন। ৫টা ৩৯ এ ট্রেন। ট্রেনের ঘোষণাও হয়ে গিয়েছে। তার পরেও মেয়েটি মাঝেমধ্যেই প্ল্যাটফর্মের ধারে গিয়ে ঝুঁকে দেখছেন, ট্রেন আসছে কি না।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৩৫
Share:

প্রাণপণ ছুটেও ‘মিস’ হয়ে গেল ৪টে ২৬ এর লোকাল।

Advertisement

কৃষ্ণনগর স্টেশনে বসে বছর চব্বিশের তরুণীর আফশোসের অন্ত নেই, ‘‘ধুস, কপালটাই খারাপ। আর কয়েক সেকেন্ড আগে পৌঁছলেও ট্রেনটা পেয়ে যেতাম! সন্ধ্যার পরে আবার সেই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে ভাবলেই শিউরে উঠছি।’’

বহরমপুর স্টেশনের বছর বাইশের মেয়েটি আবার বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। মাঝেমধ্যেই ঘড়ি দেখছেন। ৫টা ৩৯ এ ট্রেন। ট্রেনের ঘোষণাও হয়ে গিয়েছে। তার পরেও মেয়েটি মাঝেমধ্যেই প্ল্যাটফর্মের ধারে গিয়ে ঝুঁকে দেখছেন, ট্রেন আসছে কি না। তাঁরও সেই এক উদ্বেগ, ‘‘স্টেশন থেকে বাড়ির পথ সাকুল্যে এক কিলোমিটার। কিন্তু ওই পথটুকু যেতে যা ভয় লাগে!’’

Advertisement

এই দুই তরুণীকে কি চেনা চেনা ঠেকছে? কিংবা এলাকাটা? সন্ধ্যার পরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের প্রায় যে কোনও বাসস্ট্যান্ড কিংবা রেল স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ালে এমন অসংখ্য মহিলাদের খুঁজে পাওয়া যাবে। কেউ অফিস থেকে ফিরছেন, কেউ টিউশন নিয়ে কিংবা কেউ নিজের কাজ সেরে। কমবেশি প্রত্যেকেই উদ্বিগ্ন তাঁদের বাড়ি ফেরা নিয়ে।

সেই আঁধার পথেই ওত পেতে থাকে বিপদ। চুরি, ছিনতাই, দুর্ঘটনা যে একেবারেই হয় না তা নয়। তবে তার থেকেও বেশি ভয় মোটরবাইকের। তাদের দৌরাত্ম্যে সন্ধ্যার পরে একা পথ চলাই দায় হয়ে পড়ছে মহিলাদের। একা কেন, সঙ্গে কেউ থাকলেও কি বিপদ এড়ানো যাচ্ছে?

প্ল্যাটফর্মে কোনও রকম সমস্যা নেই। বিস্তর লোকজন, আলো, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথ তো অন্ধকারে ডুবে থাকে। আর সেই আঁধার পথে ওত পেতে থাকে ওরা। আর সেই ভয়েই কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা তরুণীদের কপালে মাঘের সাঁঝেও জমতে থাকে বিনবিনে ঘাম। মনের মধ্যে উঁকি দেয়, আজও কি অন্ধকার ফুঁড়ে পিছু নেবে বেয়াড়া মোটরবাইক? আজও কি সেই অশ্লীল মন্তব্য, কটূক্তি? আজও কি সেই অপমানিত হয়ে বাড়ি ফেরা?

৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কেষ্টপুরে এক তরুণীকে তাড়া করেছিল পাঁচ মদ্যপ যুবক। এক অপরিচিতের বাড়িতে ঢুকে কোনও রকমে রেহাই পান। ওই রাতেই গড়িয়া এলাকায় এক মহিলাকে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে এক অটো চালকের বিরুদ্ধে। সমালোচনায় মুখর হয়েছে রাজধানী।

কিন্তু কলকাতার বাইরেও জেলা সদর, মফস্সল কিংবা প্রত্যন্ত গাঁয়ের রাস্তাগুলোও যে মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়, তার উদাহরণও নেহাত কম নয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সব ঘটনা কি আর পুলিশকে জানানো যায়, নাকি সেটা সম্ভব? কিন্তু এমনটা যে ঘটছে সে কথা তো পুলিশেরও অজানা নয়। বেলডাঙার এক তরুণীর অভিযোগ, স্টেশন থেকে এগিয়ে বাজারটা পেরোলেই শুরু হয় অন্ধকার রাস্তা। মোটে এক কিলোমিটার রাস্তা। কিন্তু ওই পথে হেঁটে গেলেই পিছু নেয় মোটরবাইক। ছিটকে আসে কটূক্তি, অশালীন কথাবার্তা। কখনও কখনও তার থেকে বেশি কিছু ঘটে। কখনও কখনও হেঁটে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে টোটো কিংবা রিকশায় উঠতে হয়। কিন্তু সেখানেও তো রক্ষে নেই!

ওই তরুণীর তিক্ত অভিজ্ঞতা— মুখের উপরে ঠিকরে পড়ে বাইকের হেডলাইটের আলো। তাই বাইক আরোহীদের চেনার কোনও জো নেই। কারণ, অন্য সময় মাথায় হেলমেট না থাকলেও এই সময়ে হেলমেট থাকে। আর হেলমেটেই ঢাকা পড়ে যায় পরিচয়। কখনও টোটো বা রিকশা চালক প্রতিবাদ করলে তারা বাইকের গতি বাড়িয়ে মিলিয়ে যায়। কখনও তাতেও কাজ হয় না। আবার বিষয়টি বাড়িতে জানালেও তাঁরা ভয় পাবেন। চাকরিটা ছাড়তে হবে। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন