খুচরোর আকালে অকাতরে নোট বিলিয়ে ‘মসিহা’ রাজু

ভাগ্যিস নাছোড়বান্দা ইচ্ছেগুলো আজও ওঁরা লালন করেন। আর করেন বলেই খুচরোর এই আকালে নিজের কথা ভুলে দিব্যি অন্যদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। সম্প্রতি নিজের গচ্ছিত আশি হাজার টাকা (সব একশো টাকার নোট) ভাগলপুরের একটি ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন জগৎ সিংহ জৈন।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

চাপড়া শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৭
Share:

রোগীদের টাকা খুচরো করে দিচ্ছেন রাজু পাত্র (কালো শার্ট)।— নিজস্ব চিত্র

ভাগ্যিস নাছোড়বান্দা ইচ্ছেগুলো আজও ওঁরা লালন করেন।

Advertisement

আর করেন বলেই খুচরোর এই আকালে নিজের কথা ভুলে দিব্যি অন্যদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। সম্প্রতি নিজের গচ্ছিত আশি হাজার টাকা (সব একশো টাকার নোট) ভাগলপুরের একটি ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন জগৎ সিংহ জৈন। শহরের একটি ছোট কাপড়ের দোকানের মালিক, ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জানান, অন্তত কিছু লোক তো এই টাকাতে উপকৃত হবেন।

নদিয়ার মুখ্য ডাকঘরের কর্মী, বছর চল্লিশের রাজু পাত্র জগৎ সিংহকে চেনেন না। এই ঘটনার কথাও তিনি জানতেন না। কিন্তু রবিবার দুপুরে দুই প্রজন্মকে মিলিয়ে দিল তাঁদের কাজ। রবিবার সকালে চাপড়া গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের পুরনো পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট খুচরো করে দিয়েছেন কৃষ্ণনগরের দোগাছির ওই বাসিন্দা।

Advertisement

চাপড়া হাসপাতালে রাজুর এক পড়শি চিকিৎসাধীন। দিনকয়েক আগে সেই পড়শিকে দেখতে গিয়ে তিনি দেখে এসেছিলেন, পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট নিয়ে কী ভাবে নাজেহাল হচ্ছেন রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা। তখনই তিনি ঠিক করেন, কিছু একটা করতে হবে।

ডাকঘরে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে তিন দফায় রাজু ২৪ হাজার টাকা (সব একশোর নোট) তোলেন। নিজের কাছে দশ, বিশ, পঞ্চাশের নোট মিলিয়ে ছিল হাজারখানেক টাকা। খুচরো টাকার ব্যবস্থা তো হল। কিন্তু এই কাজ তো রাজু একা করতে পারবেন না। তাহলে উপায়?

মুশকিল আসানে এগিয়ে আসে চাপড়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই সংস্থার সদস্যদের নিয়ে এ দিন হাসপাতালে গিয়ে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট খুচরো করে দিলেন রাজু ও তাঁর সঙ্গীরা। ডাক বিভাগের ওই কর্মী বলছেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে তো আর সব কিছুই মেলে না। বেশ কিছু ওষুধের পাশাপাশি, জল, দুধ, ফল কিংবা যাতায়াতেও বেশ কিছু খরচ হয়। খুচরো না থাকায় চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল রোগীদের। সেই কারণেই এমন সিদ্ধান্ত।’’

দিন পাঁচেক আগে জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বড় বালিয়াডাঙার বক্স শেখ। ছেলে সাহেব শেখের হাতে টাকা আছে। কিন্তু সবই পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট। সে নোট কেউই নিতে
চাইছেন না। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পরে তিনি ব্যাঙ্কেও যেতে পারেননি। এ দিন রাজু তাঁদের এক হাজার টাকা খুচরো করে দিয়েছেন। হাতে একশো, পঞ্চাশের নোট পেয়ে সাহেব বলছেন, ‘‘ও তো মসিহা গো। এই খুচরোটা না পেলে বাধ্য হয়ে বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হত।’’

হাটরার আমেনা বিবির স্বামীও দু’দিন ধরে চিকিৎসাধীন। কিছুতেই জ্বর কমছে না। আমিনা বলছেন, ‘‘ওষুধ ধারে কিনেছি। কাল রাত থেকে খাবারও কিনতে পারিনি। এমন সময় লোকটা যেচে এসে টাকা খুচরো করে দিয়ে গেল। এমন লোকও আছে!’’ এ দিন হাসপাতালে প্রায় ১৭ হাজার টাকা খুচরো করে দিয়েছেন রাজু। বাকি টাকাটাও রাখা থাকছে। তিনি নিজের ফোন নম্বর রোগীদের দিয়ে এসেছেন। বলে এসেছেন, খুচরোর প্রয়োজনে ফোন করলে তিনি আবার আসবেন।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ আধিকারিক তাপস রায় বলছেন, ‘‘এখন চিকিৎসার প্রায় সব খরচই আমরা বহন করি। কিন্তু তারপরেও নানা জরুরি খরচ থাকে। এ ভাবে যদি আরও মানুষ এগিয়ে আসেন তাহলে খুচরোর এই হাহাকার অনেকটাই কমে যাবে।’’

কিন্তু সব খুচরোই যদি ফুরিয়ে যায়, তাহলে নিজের চলবে কী করে?

‘‘সব কিছু একসঙ্গে ভাবতে গেলে চলে নাকি!’’ হাসছেন রাজু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন