‘আতঙ্ক যেন এখনও তাড়া করে ফিরছে’

কলেজে ভর্তি হওয়ার উত্তেজনায় বুধবার সারা রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। বৃহস্পতিবার খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বহরমপুরে আসব বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ঠিক সকাল সাতটায় রানিনগর থানার শেখপাড়ার বাড়ি থেকে বাবার সঙ্গে বের হই। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা করে সাড়ে ১০টা নাগাদ কলেজে এসে পৌঁছেও যাই। কলেজের গেটের সামনে রিকশা এসে দাঁড়াতেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরন তৈরি হয়। এখন থেকে আমিও এই কলেজের ছাত্রী বলে পরিচিত হবএই আনন্দ-ভাললাগা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৪ ০০:৩১
Share:

সিমপি হাসমত আরা

Advertisement

কলেজে ভর্তি হওয়ার উত্তেজনায় বুধবার সারা রাত ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। বৃহস্পতিবার খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বহরমপুরে আসব বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ঠিক সকাল সাতটায় রানিনগর থানার শেখপাড়ার বাড়ি থেকে বাবার সঙ্গে বের হই। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা করে সাড়ে ১০টা নাগাদ কলেজে এসে পৌঁছেও যাই। কলেজের গেটের সামনে রিকশা এসে দাঁড়াতেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরন তৈরি হয়। এখন থেকে আমিও এই কলেজের ছাত্রী বলে পরিচিত হবএই আনন্দ-ভাললাগা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু সেই আনন্দ মনের মধ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। সিনেমা-টিভির পর্দায় এত দিন দেখে এসেছি, চোখের সামনে এই প্রথম অনুভব করলাম।

কী ভয়াবহ দৃশ্য!

Advertisement

ভাবতে পারিনি আমাকে কোনও দিন ওই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে! নিরীহ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের দিকে লাঠি উঁচিয়ে পুলিশের তেড়ে যাওয়া, তাড়া খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া আগে কখনও দেখিনি। পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করতে না পেরে আমার মায়ের মতো এক জন মহিলা রাস্তায় লুটিয়ে পড়েলেন। আগামী দিন যারা আমার সহপাঠী হবে তাদের ছেড়ে প্রাণভয়ে আমার ছুটে পালানোঘটনার বেশ কিছুক্ষণ পরেও কোলাজের মত সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

পর পর ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলির সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় বোধ করেছি। শিউরে উঠেছি। আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়ছে না। কোথাও যেন জন্মদাগের মত ওই দৃশ্য মনের মধ্যে বাসা তৈরি করে নিল। এখনও আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে আমাকে।

কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। শুরুতে সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। ছাত্রছাত্রীদের কলরবে মুখর ছিল কলেজ চত্বর। ছুঁয়ে দেখার মত করে তখনও কলেজ দেখছি। আচমকা সব পাল্টে গেল। গোটা কলেজ চত্বর জুড়ে আতঙ্ক ফেরি করে বেড়াচ্ছে। আমার মত যারা দূর থেকে এসেছে, তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। অনুভব করলাম একটু আগের মুখর কলেজে চোখের নিমেষে শূন্যতা নেমে এলো।

ইসলামপুর থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব ১৬-১৭ কিলোমিটার। ওই কলেজে গণ্ডগোল হয় শুনে বহরমপুর কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ইতিহাস নিয়ে পড়ার ইচ্ছে। সেই মত ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে মেধা তালিকা অনুযায়ী কাউন্সেলিং-এ ডাকও পাই। কাউন্সেলিং শেষে এ দিনই ভর্তি হতে হবে বলে যাবতীয় প্রস্তুতিও নিয়ে আসি। কিন্তু ‘দাদাদের’ ভুলে সব ভেস্তে গেল।

রাজনীতির ওই দাদাদের কাছে আমার প্রশ্নসমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে শহরের কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার মত প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের কী সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না?

নারজুমান শেখ

দৌলতাবাদ থানার সহড়াতলা গ্রামে আমার জন্ম। শান্তশিষ্ট গ্রাম বলতে যা বোঝায় আমার গ্রাম সেই রকম। গ্রামে দলাদলি বা বড় বিবাদ কোনও দিন হয়নি। এমনকী পঞ্চায়েত ভোটেও কোনও দিন রাজনৈতিক সংঘর্ষ চোখে পড়েনি। এই পরিবেশে বড় ওঠা আমার চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলাম, তাতে একটা কথাই মনে হয়েছেআমার গ্রাম অনেক ভাল। বহরমপুর শহর ছেড়ে তখনই পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার গ্রামের বাড়িতে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন পুলিশের লাঠির আঘাতে আমার মতই ভর্তি হতে আসা এক জন ছাত্রী আর্ত চিৎকারে কলেজের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আমার চোখের সামনে। ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে ওই সহপাঠীকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পারিনি। কেননা, তখন আমিও প্রাণভয়ে কলেজ ছেড়ে ছুটে বাইরে বের হতে চেয়েছিলাম। ছুটে পালানোর সময়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে গেলে আমাকে পিছন থেকে একটা দল এসে ধাক্কা মেরে কলেজের গেট থেকে প্রায় গলা ধাক্কা দেওয়ার মত করে বের করে দেয়। আমি কলেজের গেটের সামনের বড় রাস্তায় অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণ। ফের পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়-দৌড়।

ভয়ে-আতঙ্কে গলা শুকিয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমে ছুটতে গিয়ে ঘামে ভিজে যায় গায়ের জামা। জল খাব, তারও উপায় নেই। কলেজ ছাড়িয়ে দমকল দফতরের দিকে পালিয়ে যাওয়ায় কোনও দোকানও খুঁজে পাইনি যে জল খাব। শেষ পর্যন্ত একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে এক জন সহপাঠীও ছিল। আমি বাংলা অনার্সে ভর্তি হবো আর আমার বন্ধু ভূগোল নিয়ে। ওই গণ্ডগোলের মাঝে পড়ে আমরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। পরে সব কিছু শান্ত হয়ে যাওয়ার পরে দুজনই দুজনকে আবিষ্কার করি, আমরা একই জায়গায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে!

তার আগে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বহরমপুরে আসব বলে মা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার জন্য রান্না করেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে সকাল ১০টায় বাসে চড়ে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামি। সকাল ১১টা নাগাদ কলেজে আসি। কলেজ চত্বর তখন ‘দাদাদের’ স্লোগানে স্লোগানে মুখর। তার পরেই দু’পক্ষের মধ্যে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে যায়। পুলিশের লাঠি নিয়ে তাড়া। কলেজের আশপাশে তখন কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের কথা না শুনলেই শরীরে নেমে আসছে লাঠির আঘাত। বাড়ি থেকে আসার সময়েও ভাবতেই পারিনি এই ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে আমাকে। ভেবেছিলাম এ দিনই কাউন্সেলিং শেষে কলেজে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরে যাব হাসতে হাসতে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে না পারার আফশোস নিয়ে যেমন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, তেমনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত আমার সহপাঠীর আর্ত চিৎকার আর ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া দৃশ্য থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি না!

অনুলিখন: শুভাশিস সৈয়দ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন