পুরভোটে আসন সংরক্ষণের গেরোয় বিপাকে পড়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার তিন পুরপ্রধান-সহ বেশ কয়েকজন। সম্প্রতি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে জেলা প্রশাসন জেলার ৬টি পুরসভার আসন সংরক্ষণের যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান সিপিএমের মোজাহারুল ইসলাম ও আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জের পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডলের দু’টি ওয়ার্ডই মহিলা সংরক্ষিত করা হয়েছে। একই ভাবে কান্দি পুরসভার কংগ্রেস পুরপ্রধান গৌতম রায়ের ওয়ার্ডও সংরক্ষিত রাখা হয়েছে তফসিল প্রার্থীর জন্য। ধুলিয়ানে তৃণমূলের উপ পুরপ্রধান দিলীপ সরকার, জঙ্গিপুরে সিপিআইয়ের উপ পুরপ্রধান অশোক সাহা ও আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ পুরসভার উপ পুরপ্রধান ফব-এর রঞ্জন ভট্টাচার্যের তিনটি আসনই সংরক্ষিত হয়েছে মহিলাদের জন্য। একই অবস্থা ধুলিয়ানের দুই প্রাক্তন পুরপ্রধান, বেলডাঙার বিজেপির কাউন্সিলার-সহ কংগ্রেসের একাধিক শহর কমিটির সভাপতিদেরও।
এই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিবাদ দাখিল করা যাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দলের নেতারা সংরক্ষণের কোপে পড়লেও কংগ্রেস, সিপিএম বা তৃণমূল কোনও দলই অবশ্য সংরক্ষণ নিয়ে তেমন কোনও উচ্চবাচ্য করতে রাজি নয়। মুর্শিদাবাদে বহরমপুর বাদে ৬টি পুরসভার মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুন মাসে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, মে মাসের মধ্যেই এই সব পুরসভাগুলিতে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কথা।
জেলার ওই ৬টি পুরসভার মধ্যে মুর্শিদাবাদ (লালবাগ), বেলডাঙা ও কান্দি কংগ্রেসের দখলে। জঙ্গিপুর ও আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ দখলে রয়েছে বামেদের। ধুলিয়ান পুরসভা গত পুর নির্বাচনে কংগ্রেস দখল করলেও কংগ্রেসের সমস্ত কাউন্সিলাররা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় পুরসভার দখল নেয় তৃণমূল। ৬টি পুরসভার ১০৩ জন কাউন্সিলারের মধ্যে জেলায় বিজেপির মাত্র ১ জন কাউন্সিলার রয়েছেন। জেলায় পুরসভার আসন পুনর্বিন্যাসে বেলডাঙায় ৪টি আসন বেড়েছে। পুর এলাকা না বাড়লেও জঙ্গিপুরে ২০টি আসন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১, ধুলিয়ানে ১৯টি আসন বেড়ে হয়েছে ২১ এবং কান্দিতে ১টি আসন বেড়ে দাঁড়িয়েছে১৭ থেকে ১৮। জঙ্গিপুরে ৮ নম্বর ওয়ার্ড ভেঙে ২১ নম্বর ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। ধুলিয়ানে এলাকা পুনর্বিন্যাস নিয়ে সব দলের তরফে একাধিক প্রস্তাব জমা পড়লেও শেষ পর্যন্ত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নিয়ম মেনেই ৯ নম্বর ওয়ার্ডকে ভেঙে ২০ নম্বর ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডকে ভেঙে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের পুনর্বিন্যাস চূড়ান্ত করা হয়েছে। কান্দিতে বর্ধিত ১টি ওয়ার্ড ১৮ নম্বর তৈরি করা হয়েছে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডকে ভেঙে।
দলীয় সূত্রে খবর, আসনের এই গেরোয় তাঁরা বিকল্প রাস্তাও ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন। আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জের পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডলের নিজের ওয়ার্ড বলে সে ভাবে কিছু নেই। তিনি কখনও ১৬ নম্বর, কখনও ১০ নম্বর, কখনও বা ৮ নম্বর থেকে প্রার্থী হয়েছেন। এ বারে ৮ নম্বর আসনটি সংরক্ষিত হওয়ায় সিপিএম যে তাকে অন্য ওয়ার্ডে প্রার্থী করবে তা বলাই বাহুল্য। জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম গত দুটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জিতে এসেছেন ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। এ বার ওই ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় পাশের কোনও নিরাপদ ওয়ার্ডে তাঁকে দাঁড় করানো হবে। একই ভাবে প্রার্থী করা হবে কান্দির পুরপ্রধান গৌতম রায়কেও। ধুলিয়ানের উপ পুরপ্রধান দিলীপ সরকারের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। নিজের ওয়ার্ডে তিনি তিন বার জিতেছেন। তাই নিজের ওয়ার্ড অন্য কাউকে না ছেড়ে তাঁর স্ত্রীকে প্রার্থী করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশের কোনও ওয়ার্ড থেকে নিজে দাঁড়াবার চিন্তা ভাবনা করছেন তিনি।
জঙ্গিপুরের সিপিআই উপপুরপ্রধান অশোক সাহার ১৬ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় অবশ্য তেমন সমস্যা নেই। কারণ দীর্ঘ দিন ধরেই ওই ওয়ার্ডে কখনও তাঁর স্ত্রী, কখনও দাদা, কখনও নিজেই প্রার্থী হয়ে জিতে আসছেন তিনি। তবে জঙ্গিপুরে নিজের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড দীর্ঘদিন দখলে রেখেছেন তৃণণূলের গৌতম রুদ্র। সেই ওয়ার্ডে কখনও তিনি নিজে দাঁড়িয়েছেন, কখনও দাঁড় করিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে। এ বারে সে ওয়ার্ড তফসিল সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে দাঁড়াতে পারবেন না গৌতমবাবুর পরিবারের কেউই। টানা তিন বার ভোটে জিতেও এ বারে সংরক্ষণের কোপে রীতিমতো বিড়ম্বনায় কংগ্রেসের বিকাশ নন্দয়। ১৪ নম্বর ওয়ার্ড এ বারে তফসিল মহিলা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। ফলে বিকাশবাবু তাঁর স্ত্রীকেও দাঁড় করাতে পারছেন না। বিকাশবাবু ইতিমধ্যে এই সংরক্ষণ বিধি নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার ওয়ার্ডে মাত্র ১৬৯ জন তফসিল জাতির ভোটার রয়েছেন। আশপাশের ওয়ার্ডে দুই থেকে আড়াই হাজার তফসিল জাতির লোকজন থাকা সত্বেও সেগুি ল সংরক্ষিত হয়নি। এই নিয়ে কমিশনের কাছে আপত্তি জানাব। যদি সে আপত্তি গ্রাহ্য না হয় তাহলে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী হওয়ার আবেদন করব দলের কাছে।”
জেলার কোনও রাজনৈতিক দলই অবশ্য সংরক্ষণ নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বিবাদে যেতে রাজি নয়। তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন বলেন, “ঘোষিত সংরক্ষণে যে আমরা খুশি তা বলব না। তবে শাসক দল হিসেবে আগ বাড়িয়ে কোনও আপত্তিতেও যাব না। কারণ তাতেও কেউ কেউ চক্রান্তের ভূত দেখতে শুরু করবেন। জেলায় পুর নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্য দল প্রস্তুত। তাই সংরক্ষণ নিয়ে আর চিন্তিত নই আমরা।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বলেন, “আসন সংরক্ষণের নিয়মে পুর প্রধানরা বাদ পড়লে পড়বেন। কোনও আসনই কারও নিজস্ব নয়, সব আসনই দলের। সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী পাওয়া নিয়ে জেলায় কোনও সমস্যা নেই বামেদের।” জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অশোক দাস বলেন, “সংরক্ষণ নিয়ে কোনও পুরসভা থেকেই কোনও আপত্তি এখনও আসেনি। ৬টি পুর শহরের দলীয় সভাপতিরা এই বিষয়গুলি দেখছেন। তবে প্রতিটি আসনেই প্রার্থী দেবে।”