চুরি রুখতে মোটরবাইক পাহারা দিচ্ছে পুলিশ

হন্তদন্ত হয়ে মোটরবাইক নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছিলেন সাগরদিঘির সোলেমান শেখ। সিঙ্গল স্ট্যান্ডে বাইকটা দাঁড় করাতেই হইহই করে ছুটে এলেন এক সিভিক ভলেন্টিয়ার। বললেন, “না, না, একদম এখানে নয়। বাইক নিয়ে আসুন এ দিকে।”

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

এ ভাবেই চলছে নজরদারি। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

হন্তদন্ত হয়ে মোটরবাইক নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছিলেন সাগরদিঘির সোলেমান শেখ। সিঙ্গল স্ট্যান্ডে বাইকটা দাঁড় করাতেই হইহই করে ছুটে এলেন এক সিভিক ভলেন্টিয়ার। বললেন, “না, না, একদম এখানে নয়। বাইক নিয়ে আসুন এ দিকে।”

Advertisement

বাহন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোলেমানের অবস্থা তখন দেখার মতো। একে বন্ধুর বাইক, তার উপরে আবার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই! পরে অবশ্য ভুল ভাঙে ওই যুবকের। তিনি জানতে পারেন জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে একফালি ফাঁকা জায়গায় মোটরবাইক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেই বাইক পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। একেবারে নিখরচায়।

সোলেমান বলছেন, “কী বলছেন দাদা! ভয় পাব না? পুলিশের ভয়ে মূল রাস্তা এড়িয়ে এ গলি, ও গলি ঘুরে হাসপাতালে এসেছিলাম। আর এসে দেখি পুলিশ আমাকেই ডাকছে।”

Advertisement

সুতির মানজারুলের শেখের অভিজ্ঞতা একটু অন্য রকমের। পুলিশের এই পরিষেবায় তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন। খোদ পুলিশই যদি বাইক পাহারা দেয়, তাহলে আর ভয়ের কী আছে? কিন্তু বাইক নিয়ে সইসাবুদ করে বেরনোর সময় তিনি অভ্যেস মতো পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে পুলিশকে দিতে যাচ্ছিলেন। গম্ভীর মুখ করে সেই সিভিক ভলেন্টিয়ার অবশ্য জানিয়ে দেন, “আম আর আমড়া এক করবেন না দাদা। এখানে বাইক রাখতে পয়সা লাগে না।”

“না, মানে, সরি...আসলে বুঝতে পারিনি।” বলে কোনওমতে বাইক নিয়ে চলে যান মানজারুল। তিনি বলছেন, “গায়ে পড়ে পুলিশ উপকার করছে। ভাবা যায়!”

জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে প্রায় ৯০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে লোহার পাইপ দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে মোটর সাইকেল রাখার জায়গা। সেখানে পাহারায় রয়েছেন পাঁচ জন সিভিক ভলেন্টিয়ার্স। বাইক রাখার জন্য কোনও টাকা-পয়সাও নেওয়া হচ্ছে না। আর বিষয়টি না জেনে হাসপাতালে ঢুকে কমবেশি এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন অনেকেই।

স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, “দেখুন ব্যাপারটা তো অবাক করার মতোই। পথেঘাটে পুলিশ বাইক থামাচ্ছে মানে তো ছত্রিশ ঘায়ের গল্প। ফলে লোকজন প্রথমে তেমনটাই ভেবে ফেলছেন।”

কিন্তু হাসপাতালে পুলিশ হঠাৎ বাইক পাহারার ব্যবস্থা করল কেন?

পুলিশ সূত্রে খবর, গত দেড় মাসে রঘুনাথগঞ্জে চুরি গিয়েছে অন্তত ৩৭টি মোটরবাইক। কারও বাইক চুরি গিয়েছে বাসস্ট্যান্ড থেকে, কেউ ব্যাঙ্কের মোড়ে বাইক রেখে কাজ সেরে ফিরে দেখেন বাইক হাওয়া। তবে সবথেকে বেশি বাইক চুরি গিয়েছে জঙ্গিপুর হাসপাতাল চত্বর থেকে। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, “হাসপাতালে যাঁরা আসেন তাঁরা সকলেই উদ্বিগ্ন থাকেন পরিজনের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে বাইক চুরি করে দুষ্কৃতীরা।” তাই হাসপাতাল চত্বরে চুরি রুখতেই পুলিশ এমন ব্যবস্থা করে। সেখানে বাইক রাখার সময় চালককে খাতায় সই করতে হচ্ছে। নেওয়ার সময়ও একই নিয়ম।

এলাকার একটা বড় অংশের মানুষ কিন্তু পুলিশের এই উদ্যোগে খুশি। তাঁরা জানান, সম্প্রতি রঘুনাথগঞ্জে যে ভাবে মোটরবাইক চুরির হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তাতে বাড়ি থেকে বাইক বের করতেই ভয় লাগত। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলছেন, “চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই উধাও হয়ে যেত বাইক। আমার এক পরিচিত লোক দিনকয়েক আগে হাসপাতালে এসেছিলেন অসুস্থ এক পরিজনকে দেখতে। বাইকটা রেখে হাসপাতালের ভিতরে গিয়েছিলেন। ফিরে দেখেন বাইক নেই। এ বার অন্তত সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া গেল।”

রঘুনাথগঞ্জের আইসি সৈয়দ রেজাউল কবীর বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে আমরা এটা করেছি। সেখানে বাইক পাহারার কাজ সামলাচ্ছে সিভিক ভলেন্টিয়ার্স।” আইসি-র দাবি, এর ফলে মোটরবাইক চুরি যেমন বন্ধ হবে, তেমনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যানজটও কমবে। হাসপাতালের সুপার শাশ্বত মণ্ডল বলেন, “প্রস্তাবটা যখন আসে আমরা না করিনি। এখন তো শুনছি বাইক চুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”

তবে হাসপাতালে এসে হতভম্ব অনেক বাইক চালকেরই বক্তব্য, “গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে বলে একটা সাইনবোর্ড টাঙালেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। গাড়ির কাগজপত্র, হেলমেট সবসময় তো আর সঙ্গে থাকে না। ফলে পুলিশ দেখলেই একটু ভয়, না মানে ঠিক ভয় নয়, একটু অস্বস্তি তো হয়ই।” যা শুনে মুচকি হেসে এক পুলিশ কর্তা বলছেন, “এই অস্বস্তি থেকেও যদি এ বার হেলমেট, আর কাগজপত্র রাখার অভ্যাস তৈরি হয় তাহলে সেটাও কিন্তু কম প্রাপ্তি নয়।”

পাহারায় যখন খোদ পুলিশ। তখন তক্কে তক্কে থেকেও লাভ নেই তস্করের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন