এই সেই লিফলেট। —নিজস্ব চিত্র।
পরনে মলিন চেক লুঙ্গি। সঙ্গে একটি লজ্ঝড়ে সাইকেল। সাতসকালে হাতে একগোছা কাগজ নিয়ে বৃদ্ধকে দোকানে ঢুকতে দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন ডোমকলের জনাকয়েক ব্যবসায়ী। ভেবেছিলেন, ফের বোধহয় কোনও সাহায্যের আবেদন। কিন্তু দোকানে ঢুকেই বৃদ্ধ বললেন, “কাগজে এই যে ছবিটা দেখছেন, এটা আমার ছেলের। নেশার টাকা না পেলে চুরি করে। ওর থেকে সাবধানে থাকবেন। কাগজটা রাখুন। এতে সব লেখা আছে।”
টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন আগেই। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না ডোমকলের আসাদ আলি। লোকজনকে সতর্ক করতে শেষ পর্যন্ত লিফলেট ছাপিয়েছেন। বাজারের বিভিন্ন দোকানে, মোড়ে, চায়ের দোকানে ওই বৃদ্ধ নিজেই সেই লিফলেট বিলি করেছেন। বাজারে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, “ধন্য ছেলে বটে। বুড়ো বাপকে পথে নামিয়ে ছাড়ল!”
ডোমকলের গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আসাদ আলি পেশায় দিনমজুর। সংসারে অভাব থাকলেও এতদিন শান্তি ছিল। কিন্তু ছেলে হাফিজুলের কাজকর্মে শান্তি তো দূরের কথা সবসময়ে আতঙ্কে থাকেন আসাদ ও তাঁর বাড়ির লোকজন। আসাদের আতঙ্ক যে অমূলক নয় সেটা টের পাওয়া গেল তাঁর বাড়ি ঢোকার আগে। বাড়ির সামনে মোটরবাইকটা রাখতেই পড়শিদের প্রশ্ন, “হাফিজুল নিশ্চয় আপনাদেরও কিছু চুরি করে নিয়ে এসেছে?”
বাড়ির দাওয়ায় বসে আসাদ বলছেন, “এ বার বুঝতে পারছেন তো বাপ হয়েও কেন এমন পথ বেছে নিতে হয়েছে। ছেলের জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। সকাল হলেই চুরি যাওয়া জিনিস ফেরত পেতে বাড়িতে এসে কেউ না কেউ হাজির হয়।” চিকিৎসা, শিকলে বেঁধে রাখা, শাসন, মারধর, কোনও কিছুতেই ছেলেকে নেশা ছাড়াতে পারেননি, চুরির অভ্যাসও বন্ধ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে লিফলেট বিলি করছেন আসাদ।
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর চারেক আগে ওড়িশায় কাজ করতে গিয়েছিল হাফিজুল। সেখানেই হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে বছর ত্রিশের ওই যুবক। বাড়ি ফিরে এসে নেশার টাকা না পেলে প্রথমে বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করত। এখন চুরিটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কোথাও ধরা পড়লে সে তার বাড়ির ঠিকানা দিচ্ছে। আর বাড়িতে এসে লোকজন অপমান করে যাচ্ছে। কখনও ছেলের অন্যায়ের জন্য আসাদকেই মেটাতে হচ্ছে জরিমানার টাকা। আসাদ বলছেন, “ও যে কখন কোথায় থাকে আমরা তা-ও জানি না। গত এক মাসে সে একবারও বাড়ি আসেনি। বৌমাও নাতনিকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।”
ডোমকল ও লাগোয়া এলাকায় হেরোইনের রমরমা বহুদিনের। আর সেই নেশায় আসক্তদের চুরি করার ঘটনাও কিছু নতুন নয়। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ধৃত হেরোইনে আসক্ত। বিষয়টি অজানা নয় প্রশাসনেরও। ডোমকলের এসডিপিও অরিজিৎ সিংহ বলেন, “ডোমকলে হেরোইনের কারবার রুখতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।”
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “আসক্ত ব্যক্তি নেশার বস্তু পেতে চুরি, ছিনতাই করার বহু নজির রয়েছে। তবে পরিবার ছেলেটিকে এ ভাবে অস্বীকার করায় ওই যুবককে হয়তো আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হল। চিকিৎসার মাধ্যমে ওকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।” তবে নেশাসক্তদের আবাসিক করে রেখে নেশা ছাড়ানোর কেন্দ্র যে মুর্শিদাবাদে নেই, তাও স্বীকার করেন রঞ্জনবাবু।