জুয়ার জাল ছেয়েছে বেলডাঙায়, উদ্বেগ

চিত্র ১: ঘুপচি গলির মধ্যে বসে রয়েছে জনাকয়েক লোক। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে সকলেই বুঝি গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘ইঁদুর, ডাইস নাকি তিন তাস?’ দু’একজন আবার নজর রাখে রাস্তার দিকে। আচমকা লাল শার্ট গায়ে একজন হনহন করে হেঁটে যেতেই জটলাটা ভেঙে যায়। যেন কিছুই ঘটেনি।

Advertisement

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৪২
Share:

চিত্র ১: ঘুপচি গলির মধ্যে বসে রয়েছে জনাকয়েক লোক। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে সকলেই বুঝি গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘ইঁদুর, ডাইস নাকি তিন তাস?’ দু’একজন আবার নজর রাখে রাস্তার দিকে। আচমকা লাল শার্ট গায়ে একজন হনহন করে হেঁটে যেতেই জটলাটা ভেঙে যায়। যেন কিছুই ঘটেনি।

Advertisement

চিত্র ২: রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বাস। বাসের ছাদে জ্বলছে কুপি কিংবা মোমবাতি। অন্ধকার থেকে একটা গলা ভেসে আসে, ‘সব সমস্যার সমাধান দোতলায়।’ অভিজ্ঞ কান বুঝে নেয়, ‘গেম’ কোথায় চলছে। ঠিক একই ভাবে গঙ্গার পাড়ের ভিড়টাও টর্চের আলো দেখে আন্দাজ করে নেয়, সেদিনের রাত কতটা নিরাপদ।

বেলডাঙা ও লাগোয়া এলাকায় এমন দৃশ্য এখন অনেকেরই চেনা। সতর্কতা, সঙ্কেত ও নানা সাবধানতা অবলম্বন করে এভাবেই রমরমিয়ে চলছে জুয়ার আসর। তবে সবসময় যে শেষরক্ষা হচ্ছে এমন নয়। বেলডাঙা থানার ওসি অরূপ রায় বলছেন, “সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জুয়ার ঠেকে হানা দিয়ে পুলিশ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার হয়েছে ৫৭ হাজার নগদ টাকা। পশ্চিমবঙ্গ জুয়া ও বিভিন্ন পুরস্কার প্রতিযোগিতা আইন (১৯৫৭) ৩, ৪ ও ১০ ধারায় মামলাও রুজু করা হয়েছে। এই জুয়ার সঙ্গে বড় চক্রও জড়িত রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেই চক্রের খোঁজে তল্লাশিও শুরু হয়েছে।”

Advertisement

তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, অভিনব সব কৌশলে চলছে জুয়া। এলাকার সমস্ত জুয়ার ঠেকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এক বা একাধিক চক্র। লক্ষ লক্ষ টাকাও তারা এই খেলার পিছনে বিনিয়োগ করে। তারপর সেই টাকা তারা সুদে আসলে তুলেও নেয়। কী রকম? জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানান, জুয়ার ঠেক হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে গঙ্গার পাড়, কোনও ঘুপচি গলি কিংবা রাতের কোনও বাসের ছাদ। সেখানে খেলা চলে। চারপাশে ছড়ানো থাকে আরও কিছু লোক। তাদের কেউ নজর রাখে পুলিশের গাড়ির উপর। কেউ আবার নানা সঙ্কেতের মাধ্যমে জাল ছড়ায় ‘শিকার’ ধরবে বলে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ উদ্ধার করতে পেরেছে এমনই কিছু সঙ্কেত। ‘সব সমস্যার সমাধান দোতলায়’ মানে বুঝতে হবে যে জুয়ার ঠেক চলছে বাসের ছাদে। ঠিক তেমনই লাল শার্ট গায়ে একজন সামনে দিয়ে যাতায়াত করার অর্থখেলা চালানো সম্ভব নয়। পুলিশ আসছে।

জেলা পুলিশের ওই আধিকারিক বলছেন, “জুয়ার আসরে বসে যাওয়া সহজ। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কারও সর্বস্ব খোওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বাধ্য করানো হয় খেলা চালিয়ে যেতে। তারপরেই দেবদূতের মতো টাকা ধার দিতে এগিয়ে আসে ওই জুয়া চক্রেরই কোনও সদস্য। সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া লোকটার সামনে সেই টাকা তখন ফের আশা দেখায়। জটিল পাটিগণিতের অঙ্কের থেকেও তার কাছে ‘এবার একটা বেড়ে দান খেলব’ মানসিকতাটাই বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।”

পুলিশ জানিয়েছে, মাসিক শতকরা দশ টাকা সুদে ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ধার দেওয়া হয়। জুয়ায় মত্ত সেই ব্যক্তি তখন সাতপাঁচ না ভেবে সে টাকা ধারও নেয়। কিন্তু সে টাকাও সে হারিয়ে ফেলে ওই জুয়ার বোর্ডেই। তারপর পাওনা টাকা আদায় করতে উঠেপড়ে লাগে ওই চক্র। টাকা শোধ করতে না পারলে অনেক অন্যায় দাবি পর্যন্ত করা হয়। তখন সে দাবি মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া ছাড়া ঋণগ্রহীতার সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকে না।

বেলডাঙার বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের সদস্য মনিরুল হক বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজনই জুয়ার ঠেকে ভিড় করছেন বেশি। পরিশ্রম না করে খুব অল্প সময়ে বেশি টাকা আয়ের লোভেই মূলত তাঁরা ওই ফাঁদে পা দেন। পরে যখন ভুল বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। সাংসারিক অশান্তির পাশাপাশি আরও নানা সমস্যায় পড়তে হয় জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিকে।”

বহরমপুরের ডিএসপি (ডিঅ্যান্ডটি) লাল্টু হালদার বলেন, “বেলডাঙা ও লাগোয়া বেশ কিছু এলাকায় জুয়া খেলার খবর আমাদের কানেও আসছিল। সেই মতো তল্লাশি চালিয়ে এখন জুয়ার রমরমা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে এই অভিযান এখন চলবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন