অষ্টকোণাকৃতি শিবমন্দির ঢাকা পড়েছে ঝুরিতে। —নিজস্ব চিত্র।
নদী থেকে উঠে আসা নতুন দ্বীপ, নবদ্বীপ। এ শুধু কোনও স্থানের নাম নয়। নবদ্বীপ মানে এক রোমাঞ্চকর দীর্ঘ যাত্রা। সে যাত্রায় কখনও সঙ্গী বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর। কখনও তুর্কি হানাদার বখতিয়ার খলজি কিংবা বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন। এ পথেই দেখা মিলবে বাসুদেব সার্বভৌম ও স্বয়ং চৈতন্যদেবের। নবদ্বীপের মতো হাজার বছর ধরে জীবিত শহর খুব বেশি নেই আমাদের দেশে। তিনশো বছর ধরে গঙ্গার ভাঙনে খণ্ডবিখণ্ড নবদ্বীপ আজও টিকে রয়েছে। তবে অতীত গৌরবের সোনালি পালকগুলির বেশিরভাগই খসে গিয়েছে। তবুও এ শহরের আনাচকানাচে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি, বিগ্রহ, মন্দির, দুষ্পাপ্য পুথি এবং নানা ধরনের স্মারক। কিন্তু অতীত ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান যেমন যত্নে থাকার কথা তেমন ভাবে কিন্তু নেই। নিতান্ত অনাদরে উপেক্ষায় অবহেলিত হাজার কিংবা দেড় হাজার বছরের পুঁথি এখানে নদীর পলি জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। উপযুক্ত নজরদারির অভাবে বুনো রামনাথের ভিটেয় রক্ষিত পুথি উইপোকা খেয়ে মাটি করে ফেলেছে। সুযোগ সন্ধানীরা গোপনে মোটা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন দুষ্প্রাপ্য পুথি। সপ্তদশ শতকে গড়ে ওঠা নবদ্বীপের প্রথম বৈষ্ণব আখড়ার নাটমন্দির স্থানীয় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গুদামে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাঙা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী তোরণ। মঠমন্দির থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে পাথর এবং ধাতুনির্মিত বহুমূল্য সুপ্রাচীন সব মূর্তি। তার বেশির ভাগের হদিশ মেলেনি। দুষ্কৃতীদের চোখে ধুলো দিতে নবদ্বীপের কোনও কোনও মন্দিরে মূল্যবান ধাতব মূর্তি কালো রং করে রাখা আছে। আবার কোনও মন্দিরে চোরের ভয়ে সারাবছর দেবতাকে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে রাখা হয়।
প্রাচীন শহর নবদ্বীপে রয়েছে ছোট বড় দেড় শতাধিক মঠমন্দির। সেখানে রয়েছে বহু প্রাচীন বিগ্রহ, পুঁথি, গ্রন্থ কিংবা অন্য কোনও বহুমূল্য দ্রব্য। পাশাপাশি নবদ্বীপে এমন কোনও মঠমন্দির খুঁজে পাওয়া ভার, যেখানে কখনও চুরি হয়নি। বিষ্ণুপ্রিয়া সেবিত মহাপ্রভু মন্দিরের ধাতব বিগ্রহ, ভবতারিণী মন্দিরের অলঙ্কার, বুড়োশিব মন্দিরের পাথরের দুর্গা, হংসবাহন শিব, পালচৌধুরী বাড়ির রাধাকৃষ্ণ, সুপ্রাচীন মঙ্গলচণ্ডী মূর্তির মতো দুষ্প্রাপ্য মূর্তি চুরির পাশাপাশি অসংখ্য ছোটবড় চুরির ঘটনা ঘটেছে মঠ মন্দিরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ সব চুরির কোনও কিনারা হয় না। উদ্বেগ এবং নিরাপত্তাহীনতা নিয়েই রাত কাটে নবদ্বীপের মঠমন্দির প্রধানদের। শুধু তাই-ই নয়, এ শহরের বহু পরিবারেই রয়েছে প্রাচীন বিগ্রহ, পুঁথি বা মূল্যবান স্মারক। বলা বাহুল্য সেই সব পরিবারেরও রাত কাটে দুশ্চিন্তায়। কিন্তু এইসব মূল্যবান ঐতিহ্য রক্ষা করবে কে? নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপের উত্তর এবং পূর্ব দিক বরাবর গঙ্গা রয়েছে। নৌকা করে এসে হানা দিলে কার্যত কারও কিছু করার নেই। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন রাখছি যাতে জলপথে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়।” নবদ্বীপের প্রাচীন হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “বেশির ভাগ মন্দিরে বিগ্রহের শয়নারতির পর থেকে ভোরের মঙ্গলারতি পর্যন্ত কার্যত ফাঁকা থাকে। এই সময়ে যদি বিভিন্ন পাড়ায় আগের মতো নৈশ প্রহরার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে খুব ভাল হয়।”
মহাপ্রভু মন্দিরের নিত্যসেবা পরিচালনা করে বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতি। সমিতির সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “একবার চুরির পর আমরা মন্দিরে রাতে পাহারাদার রাখতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু বেশির ভাগ মন্দিরেরই সেই ক্ষমতা নেই। সেক্ষেত্রে পুলিশকে দায়িত্ব নিতে হবে। সিসিটিভির কথাও ভাবতে হবে।” গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের কার্যকরী সভাপতি ভাগবত কিশোর গোস্বামী বলেন, “বেশির ভাগ মঠমন্দিরের কর্তৃপক্ষ ভয়ে দেবতাকে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে রাখেন। উৎসবের সময় পুলিশ প্রহরায় অলঙ্কার পরানো হয়। বাকি সময় ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে বাধ্য হন। ক্ষমতা না থাকলেও সিসিটিভি বসাতেই হবে।”
জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “নবদ্বীপের মঠমন্দিরে মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী রয়েছে। ফলে সেখানকার নিরাপত্তা আরও বাড়ানো যায় কী করে তা নিয়ে পরিকল্পনাও চলছে।”