বইমেলার স্টলও সেজে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের নীল-সাদা রঙে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান ঘিরে এতদিন বিরোধীদের সঙ্গে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজন ছিল তৃণমূলে। এ বার বইমেলা ঘিরে ‘আমরা-ওরা’র সেই বিভাজন-সংস্কৃতি ঢুকে পড়ল খোদ মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলেরই অন্দরমহলে। বইমেলা শুরু হওয়ার ৯ দিন আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি আচমকা কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ৯ জনকে। তাঁদের মধ্যে কংগ্রেসের বিধায়ক সহরব হোসেনকে বাদ দিলে বাকি ৮ জনই তৃণমূলের বিভিন্ন পদাধিকারী। তাঁদের বাদ দিয়ে ৩৪তম মুর্শিদাবাদ জেলা বইমেলা কমিটিতে যাঁদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে তাঁরাও তৃণমূলের পদাধিকারী। কিন্তু দল এক হলেও তাঁরা কিন্তু বিরোধী গোষ্ঠীর বলেই পরিচিত। কেবল বিরোধী গোষ্ঠীই নয়, তাঁরা তৃণমূলের গায়ক-নেতা ইন্দ্রনীল সেনেরও ‘চক্ষূশূল’ বলেও প্রচারিত। আর সেই ‘অপরাধ’-এ কমিটি থেকে শেষ মুহূর্তে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূলের অভ্যম্তরেই গুঞ্জন চলছে।
জেলা বইমেলা পরিচালনা করে ২১ জন সদস্যের এলএলএ (লোকাল লাইব্রেরি অথরিটি) কমিটি। ওই ২১ জনের মধ্যে ১২ জনই সরকার মনোনীত ব্যক্তি। এ বারের বইমেলা নিয়ে গত নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারির আগে পর্যন্ত অন্তত ৩টি বৈঠক হয়েছে ওই ২১ জনের কমিটির উদ্যোগে। গত ২ ফেব্রুয়ারি হঠাত্ করে সেই কমিটি থেকে ৯ জনকে বাতিল করে ঢোকানো হয় নতুন ৯ জনকে। বাতিলদের মধ্যে রয়েছেন কমিটিতে থাকা একমাত্র বিরোধী দল কংগ্রেসের বিধায়ক সহরব হোসেন। বাতিলের তালিকায় রয়েছেন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রাক্তন জেলা সভাপতি উত্পল পাল, তৃণমূল কৃষক কংগ্রেসের প্রাক্তন জেলা সভাপতি আব্দুল মাতিন, তৃণমূল নেতা বাগবুল হোসেন, তৃণমূলের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের জেলানেতা প্রিয়তোষ ঘোষ, জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ পুরসভার ২ জন তৃণমূল কাউন্সিলর, সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির একজন তৃণমূল সদস্য।
সহরবের জায়গায় ঠাঁই পেয়েছেন পরিষদীয় সচিব চাঁদ মহম্মদকে। যে কমিটির সভাপতি জেলাশাসক সেই কমিটির সাধারণ সদস্য পদে বসানো হয়েছে সব রকমের ‘প্রোটোকল’ তুচ্ছ করে পরিষদীয় সচিব চাঁদ মহম্মদকে। অথচ ওই বিতর্কের সুযোগই থাকত না, যদি ওই পদে সাগরদিঘির বিধায়ক সুব্রত সাহাকে জায়গা দেওয়া হত। এ বিষয়ে জানাতে চাইলে সুব্রত সাহার দায়সারা বক্তব্য, “বইমেলা কমিটি নিয়ে কি হয়েছে, না হয়েছ তা আমার জানা নেই। ফলে ওই বিষয়ে কোনও কথা বলা সম্ভব নয়।” উত্পল পালের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে ‘প্রখ্যাত সমাজসেবী’ পরিচয় দিয়ে রাজ্য যুব তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক সৌমিক হোসেনকে, মাতিনের জায়গায় ‘প্রখাত শিক্ষাবিদ’ পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি অশেষ ঘোষকে।
বাগবুলের জায়গায় ‘প্রখ্যাত সংস্কৃতিক কর্মী’র পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি অরিন্দম ঘোষ রাজাকে এবং প্রিয়তোষ ঘোষের বদলে ‘প্রখ্যাত শিল্পকর্মী’ পরিচয় দিয়ে আনা হয়েছে তৃণমূল কর্মী প্রবীর ভট্টাচার্যকে। বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে। স্থানীয় বহরমপুর লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা ও মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদ রয়েছে কংগ্রেসের দখলে। অথচ স্থানীয় সাংসদ, বিধায়ক, পুরপ্রধান ও জেলাপরিষদের সভাধিপতি কাউকেই বইমেলা কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া হয়নি। আমন্ত্রণপত্রেও তাঁদের নাম নেই। উল্টে বিগত নির্বাচনে বহরমপুরের পাশের লোকসভা কেন্দ্র মুর্শিদাবাদের পরাজিত প্রার্থী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনকে বইমেলার স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি করা হয়েছে প্রাক্তন সাংসদ পরিচয় দিয়ে।
সৌমিক হোসেন মান্নান হোসেনের ছেলে। আবার প্রচার রয়েছে, সৌমিকের একান্ত অনুগত অশেষ ঘোষ। ফলে তৃণমূলের অন্দরেই জোর গুঞ্জন, “এটা সরকারি বইমেলা নয়। নয় তৃণমূলের মেলা। এটা আসলে ‘পিতা-পুত্র’ ও অশেষের মেলাখেলা।” এ বিষয়ে জানাতে চাইলে সৌমিক হোসেনের জবাব, “এ বারের বইমলা কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। আর সেই সিদ্ধান্ত যৌথ ভাবে কার্যকর করেছে অশেষ ঘোষ ও রাজা ঘোষ। এ বিষয়ে যা বলার ওঁরাই বলবেন।” অশেষ ঘোষের পাল্টা জবাব, “সৌমিক হোসেন আমাদের নেতা। বইমেলার সব কিছু হয়েছে সৌমিক হেসেনের নেতৃত্বে। এ বিষয়ে যা বলার তিনিই বলবেন।”
যা শুনে মান্নান-ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূলেরই এক জেলা নেতা বলছেন, “এ সব যা চলছে, বইমেলা নিয়ে আসলে প্রকাশ্যে কিছুই বলার আজ আর মুখ নেই তাঁদের।”