বধূকে সারাতে আরবি মন্ত্র ওঝার

কখনও রাতের অন্ধকারে ‘নিশির ডাকে’ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, কখনও বা হাতের সামনে যা পান তাই ছুড়ে মারেন প্রিয়জনের দিকে, কখনও নিজের মাথাতেই ঢেলে দেন ব্যারেল ভর্তি ডিজেল আবার কখনও বা একেবারে লক্ষ্মী বউটির মতো সামলান ঘর-কন্যা। ঘরের বউয়ের ঘনঘন ‘রূপ’ পরিবর্তন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ঘরের লোক। চিকিৎসায় ভরসা নেই বলে গুণিন ডেকে এনেছিলেন তাঁরা। সোমবার সকালে নদিয়ার হাঁসখালি থানার বগুলা-সাহাপুর গ্রামের বছর আঠাশের এক বধূকে বারান্দায় বসিয়ে রীতিমতো ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে মন্ত্রঃপূত মাদুলি পড়িয়ে দিলেন দুই গুণিন।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

বগুলা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০২:০৮
Share:

কখনও রাতের অন্ধকারে ‘নিশির ডাকে’ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, কখনও বা হাতের সামনে যা পান তাই ছুড়ে মারেন প্রিয়জনের দিকে, কখনও নিজের মাথাতেই ঢেলে দেন ব্যারেল ভর্তি ডিজেল আবার কখনও বা একেবারে লক্ষ্মী বউটির মতো সামলান ঘর-কন্যা। ঘরের বউয়ের ঘনঘন ‘রূপ’ পরিবর্তন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ঘরের লোক। চিকিৎসায় ভরসা নেই বলে গুণিন ডেকে এনেছিলেন তাঁরা। সোমবার সকালে নদিয়ার হাঁসখালি থানার বগুলা-সাহাপুর গ্রামের বছর আঠাশের এক বধূকে বারান্দায় বসিয়ে রীতিমতো ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে মন্ত্রঃপূত মাদুলি পড়িয়ে দিলেন দুই গুণিন। বিশ্বায়নের যুগেও প্রত্যন্ত গ্রামবাংলা যে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণাতেই পড়ে, আবারও প্রমাণ করে দিল নদিয়ার এই ঘটনা।

Advertisement

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই তরুণী মাজদিয়ার চৌগাছা এলাকায় মাসির বাড়িতে বড় হয়েছেন। প্রায় আট বছর আগে দরিদ্র কৃষক সুবীর রায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বছর ছয়েক আগে তিনি এক কন্যা সন্তান প্রসব করার পরে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ধীরে-ধীরে। বাড়ির লোকেরা মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু মাস ছয়েক আগে ফের কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয়। ফের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এ বার সেরে ওঠার আগেই চিকিৎসা বন্ধ করে দেন বাড়ির লোক। এই অবস্থায় ‘পাগলামির’ মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। টিনের চালের ঘরের দাওয়ায় পায়া ভাঙা কাঠের চৌকির উপরে বসে সুবীর বলেন, ‘‘ছ’বছর ধরে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। এখন দেখি ওঝা-গুণিনে কিছু করতে পারে কিনা।”

গুণিন খতিয়ে দেখে নিদান দেন, ‘জিনে ধরেছে বউকে।’ এলাকার গুণিন মোশারফ মণ্ডল ওরফে মশা মিঙা আবার জানিয়ে দেন, এত বড় জিন তাড়ানো একা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ডাকা হয় মশার ওস্তাদ ইব্রাহিম মৌলানাকে। ধূপ-ধুনো জ্বেলে প্রায় ঘণ্টাখানেক মন্ত্র পড়ে বধূর হাতে-গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মাদুলি। আর ঘরের ভিতরে যাতে ওই জিন ঢুকতে না পারে তার জন্য বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে আরবিতে লেখা কাগজ। কী লেখা আছে ওই কাগজে? ঘরের দাওয়ায় বসে পা নাচাতে-নাচাতে মশা মিঙা বলেন, ‘‘ওটা আরবি মন্তর। বলা যাবে না। তাহলে আর মন্তরের জোর থাকবে না।’’ প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে গুণিনের শলা নিতে-নিতে শ্বশুর কুমারেশ রায় বললেন, ‘‘মাথার ব্যামো হলে এতদিনে ডাক্তাররা সারিয়ে তুলতে পারতেন। তারা যখন কিছু করতে পারলেন না, তখন দেখি গুণিনে কিছু করতে পারে কি না?

Advertisement

কিন্তু চিকিৎসা কী সম্পূর্ণ করা হয়েছিল? উত্তর নেই বাড়ির

লোকের মুখে।

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক অশোককুমার আড্ডি মনে করছেন ঠিক মতো চিকিৎসা করলে ওই বধূকে সারানো সম্ভব হত। তিনি জানান, প্রসবের পরে অনেক মহিলারই এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। একে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ‘পুয়েরপেরাল সাইকোসিস’। এই রোগীদের নিজের সন্তানের প্রতি একটা অনীহা তৈরি হয়। এমনকী তাঁরা নিজের সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারেন। তবে মাস ছ’য়েকের টানা চিকিৎসার পর রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই চিকিৎসা ব্যয়বহুলও নয়। দ্বিতীয়বার আবার প্রসবের পর রোগটি ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। চিকিৎসকের কথা শুনে ওষুধ খেলে সেরে যেত সেক্ষেত্রে।

কিন্তু যাঁদের এই সচেতনতা নেই, কিংবা ধারাবাহিক ভাবে এই চিকিসার ব্যয়বহন করার ক্ষমতা নেই, তাঁরা কী করবেন? এই প্রশ্নে দায় এড়িয়েছেন সমাজকল্যাণ দফতর থেকে শুরু করে জেলার স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও। জেলা সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিক অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের কাছে নির্দিষ্ট করে কিছু না চাইলে আমরা কী করব? হোমে রেখে চিকিৎসা হলে আমরা তার ব্যবস্থা করতে পারি। তাছাড়া এই ধরনের রোগীদের চিকিসার ব্যবস্থা করা উচিত স্বাস্থ্য দফতরের।”

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অধীপ ঘোষ জানান, মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে গেলে আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন হয়। পরিবারের লোক কিংবা হাসপাতালের সুপারের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এই ধরনের নির্দেশ দিতে পারে।

এত কিছু জানা নেই গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলির। সেই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে এখনও গ্রামে-গঞ্জে মশা মিঙা কিংবা ইব্রাহিম মৌলানাদের দাপট চলে। আরবি অক্ষরে লেখা এক টুকরো কাগজের মন্ত্রে উড়ে যায় চিকিৎসা বিজ্ঞান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন