রোদ উঠতেই স্বস্তি ফিরেছে কৃষ্ণনগর পালপাড়ায়। নিজস্ব চিত্র
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে কৃষ্ণনগরে শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজো। বর্তমানে দুর্গা বা কালী পুজো নয়, জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য সম্বৎসর অপেক্ষায় থাকে কৃষ্ণনগর। কিন্তু মাঝে মাঝে বৃষ্টি বা মেঘলা আকাশ বাধ সাধছিল সেই পুজোর আয়োজনে। তবে মঙ্গলবার থেকে মেঘ কেটে যাওয়ায় ফের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রস্তুতিতে মেতেছে কৃষ্ণনগর।
শক্তিনগর পাঁচ মাথার মোড়ে চলছে জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপ তৈরির কাজ। পিতলের কাজে ফুটে উঠবে বুদ্ধ মন্দির। গোলাপট্টি বারোয়ারি মণ্ডপে ভেষজ রংয়ের ব্যবহারে নারকেল গাছ, শালপাতা, তালপাতা ও সুপুরি ব্যবহার করে নানা নকশা ফুটিয়ে তোলা হবে। চটের ওপর উলের কাজে মধুবনী চিত্রকলায় সাজবে মণ্ডপ। মণ্ডপ শিল্পী রবীন্দ্রভারতীর কলা বিভাগের ছাত্র সুপ্রিয় রায় চৌধুরী বলেন, “কাজে আঠার ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঝে কয়েকদিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় কাজে সমস্যা হচ্ছিল। এখন রোদ উঠতেই পুরোদমে চলছে কাজ।”
পাত্রবাজার স্বীকৃতি ক্লাবে তৈরি হচ্ছে থার্মোকলের ৭০ ফুট উচ্চতার ইস্কনের নতুন মন্দির। প্রায় ৩০ জন শিল্পী দিনরাত এক করে কাজ করছেন। এখন বাঁশ আর বাটামের কাজ চলছে। হাতারপাড়া আর নেদেরপাড়ায় মণ্ডপে কাপড়ের কাজ শুরু হয়েছে।
বাঘাডাঙা বারোয়ারিতে হাজারদুয়ারির আদলে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। মণ্ডপের ভিতরে থাকবে হাজারদুয়ারির আসবাবপত্র ও অস্ত্রশস্ত্রের মডেল। শিল্পী দেবব্রত মালাকার বলেন, “বৃষ্টি থামতেই আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। এখন মণ্ডপের বাইরের কাজও শুরু হয়েছে।”
মেঘলা আবহাওয়ায় সমস্যায় পড়েছিলেন প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে যাঁরা মণ্ডপ তৈরি করছেন সেই পুজো উদ্যোক্তারা। প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি আন্টার্কটিকার বরফ থেকে অজন্তার গুহা সবই ধুয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টিতে। মল্লিকপাড়া জলকল বারোয়ারিতে প্লাস্টার অব প্যারিসের অজন্তার গুহা তৈরি হচ্ছে। যার ভিতরে থাকবে ফাইবারের তৈরি নানা মডেল। মণ্ডপের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কোষাধ্যক্ষ জয়ন্ত গড়াই বলেন, “বৃষ্টির জন্য খরচ কিছুটা বেড়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আবহাওয়াটা ফের ভাল হয়ে গেল এই যা রক্ষের। নাহলে সবটাই মাঠে মারা যেত।”
কলেজ স্ট্রিট বারোয়ারিতে তৈরি হচ্ছে “আলিবাবা ও চল্লিশ চোর”। প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুহা। ঘূর্ণি বারোয়ারি তৈরি করছে ‘অবক্ষয়ের দিকে পৃথিবী’। দূষণের কারণে কী ভাবে আন্টার্কটিকার বরফ গলে যাচ্ছে তাই ফুটে উঠবে তাঁদের থিমে।
থার্মোকল আর প্লাইউড দিয়ে রাজস্থানের মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে ষষ্ঠীতলা বারোয়ারিতে। পুজোর সম্পাদক তথা মণ্ডপ শিল্পী দীপক বিশ্বাস বলেন, “মণ্ডপের কাজ শেষ। এখন রঙের কাজ চলছে। মাঝখানে বৃষ্টির জন্য কাজ অনেকটাই ধাক্কা খেল।”
কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি বিখ্যাত মাটির পুতুলের জন্য। সেখানকার বেশির ভাগ বারোয়ারিগুলোতেই তাই দেখা যায় প্রমাণ মাপের মাটির তৈরি মডেলের আধিক্য। ঘূর্ণি শিবতলা বারোয়ারিতে দেখা যাবে ২৫টি নির্মাণ-শ্রমিকের মডেল দিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপ। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মৃৎশিল্পী সুবীর পাল বলেন, “বৃষ্টির জন্য মডেলগুলো শুকোচ্ছিল না। খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। রোদ ওঠায় এখন আর সেই সমস্যাটা নেই।”
ঘূর্ণি স্মৃতি সঙ্ঘ এ বার ১৬টি মাটির মডেল ও মাটির বাড়ি, গাছ দিয়ে ফুটিয়ে তুলছে ‘দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি’।
গত বছর গণ্ডগোলের জেরে বন্ধ হতে বসেছিল বৌবাজার বারোয়ারি পুজো। বড়রা কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। সব দেখেশুনে তাই এগিয়ে এসেছে ছোটরা। পুজোর সম্পাদক বি কম সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র সুদীপ সিকদার বলেন, ‘‘এ বার আমাদের থিম বিশ্বকাপ। আমাদের কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ। বড়দের দেখিয়ে দিতে হবে যে ছোটরাও পারে। আর সেটা প্রমাণ করতেই দিনরাত আমরা পরিশ্রম করছি।”
নতুনবাজার পালপাড়ার বাবলা পাল বলেন, “কৃষ্ণনগরের বাইরেও আমাদের কিছু প্রতিমা যায়। এ বার বৃষ্টির কারণে সেগুলো দিতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
রায়পাড়া মালিপাড়ায় এ বারের থিম কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির। কাপড়ের কাজ শুরু হচ্ছে। শিল্পী তারক ঘোষ বলছেন, “দু’দিনের খারাপ আবহাওয়ার জন্য কাজ অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। তবে রোদ ওঠায় এখন স্বস্তি ফিরেছে।”
চৌরাস্তা সুকুল রোডে রাজদূত ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির চকবাড়ির আদলে। মণ্ডপের সামনে তৈরি হচ্ছে বিরাট হাতি। মল্লিকপাড়া বারোয়ারির এ বারের আকর্ষণ বাংলা সিরিয়াল কিরণমালা।
কালীনগরের রেনবো ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে মহাবালেশ্বরের হরেকৃষ্ণ মন্দিরের আদলে। শিল্পী বৃন্দাবন দাস বলছেন, “খারাপ আবহাওয়ার জন্য রঙের কাজ শুরু হতে একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু এখন কাজ চলছে জোরকদমে।”
নতুনপল্লির এ বারের থিম বারো মাসে তেরো পার্বণ। কৃষ্ণনগরের রাস্তায় রাস্তায় এখন তৈরি হচ্ছে বড় বড় আলোর তোরণ। কিছু কিছু জায়গায় এখন থকেই সন্ধ্যের পর আলো জ্বলছে।
বেজিখালিপাড়া বারোয়ারি প্রতিবছরই আলোকসজ্জায় নজর কাড়ে। এ বারেও তারা আলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবে চাঁদের পাহাড়। বুধবার থেকেই নুড়িপাড়া বারোয়ারিতে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। চাষাপাড়ার বুড়ি মা’র মণ্ডপে এ দিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সবমিলিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোয় মেতে উঠেছে কৃষ্ণনগর।