অবরোধে সামিল ছাত্রেরা। চাঁদপুরে নিজস্ব চিত্র।
সাতসকালে ঝাড়খণ্ডের কাবিলপুর থেকে সাইকেলে দুই ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাবা। পথেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল এক ছেলের।
মঙ্গলবার সকালে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের চাঁদপুর সেতু এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। লরির চাকায় পিষে মৃত্যু হয় মেশবাউল রহমানের (৫)। গুরুতর জখম হয়ে জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেশবাউলের দাদা মানসুরও।
দুর্ঘটনার পরই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় চাঁদপুর সেতু এলাকা। উত্তেজিত স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ একাধিক গাড়িতে ভাঙচুর চালায়। রাস্তা অবরোধ করে সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকা ঠেলাগাড়ি, অটোরিকশা নীচে মাসনা নদীতে ফেলে দেয়। সকাল পৌনে সাতটা থেকে টানা চার ঘণ্টা ধুলিয়ান-পাকুড় রাজ্য সড়ক অবরোধ করে রাখে স্কুলের হাজার খানেক ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘটনাস্থলে এসে বিক্ষোভের মুখে পড়ে পুলিশ।
দুর্ঘটনাটি ঘটল কী ভাবে?
মৃতের বাবা মানারুল হক জানান, তাঁর বড় ছেলে বসেছিল সাইকেলের সামনে। ছোটটা পিছনে। সেতুর কাছে রাস্তার দু’পাশে প্রচুর অটো, লছিমন, ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেদের সাইকেলে বসিয়ে তিনি হাঁটছিলেন। ধুলিয়ানের দিক থেকে একটি খালি লরি সেতুতে যানজটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন সাইকেল নিয়ে তিনি সেতুর উপরেই দাঁড়িয়ে পড়েন। হঠাৎ সাইকেলের পিছনে জোরে ধাক্কা মারে একটি অটো। সাইকেল-সহ দুই ছেলে রাস্তার উপরে পড়ে যায়। লরির পিছনের চাকায় পিষ্ট হয় মেশবাউল। আর মানসুর সজোরে ধাক্কা খায় চলন্ত ওই লরির চাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দুই বালককে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় ধুলিয়ানের তারাপুর কেন্দ্রীয় হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা মেশবাউলকে মৃত বলে জানান। মনসুরকে স্থানান্তরিত করা হয় জঙ্গিপুর হাসপাতালে।
এই সড়ক পথে দীর্ঘ দিন ধরে যানজটের সমস্যায় নাকাল হচ্ছেন লোকজন। মাস তিনেক আগেই পাশের বাউরিপুনি গ্রামে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক মহিলার। তখনও রাস্তা অবরোধ হয়েছিল। যানজট রুখতে প্রশাসন ওই এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরে আর ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা হয়নি। ফলে মানুষের ক্ষোভ ছিলই। এদিন সকালে দুই পড়ুয়ার হতাহতের খবর পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে।
সাহেবনগরের মোতাহার আলি বলেন, ‘‘গত এক বছরে পাঁচটি পথ দুর্ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কোনও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। সকাল থেকেই ধুলিয়ান-পাকুড় সড়কের দু’পাশে দোকান সাজিয়ে বসে পড়ছে অসংখ্য হকার। অটো, লছিমন, ট্রাক্টর আর লরির দাপটে পথ চলা দায়। আগে এলাকায় পরিবহন সুরক্ষা বাহিনী কিছুটা দেখাশোনা করত। এখন সে পাটও আর নেই।” স্থানীয় একটি ক্লাবের সম্পাদক মৈমুর আলি বলেন, ‘‘এলাকায় সব মিলিয়ে ১৮টিরও বেশি সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক, হাই স্কুল ও মাদ্রাসা রয়েছে। লাগোয়া ঝাড়খণ্ড এলাকা থেকে বহু ছাত্র আসে এখানে। কিন্তু ঝাড়খণ্ড সীমান্ত পেরিয়েই শেখপুর থেকে শুরু হয় যানজট।”
যানজটের অন্য কারণও আছে। সড়কের পাশে চোরাই কয়লার ব্যবসা চলছে রমরম করে। সেই সব কয়লা গাড়ি বোঝাই হয়ে ঝাড়খণ্ড থেকে আসছে। চাঁদপুর সেতুর মুখে চৌরাস্তা। ফলে সব রাস্তার যানবাহন এসে থামে এই সেতুতে। তখন পথচারীদের আর যাতায়াতের রাস্তা থাকে না।
এই প্রেক্ষিতে স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘ দিন ধরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ দিনের বিক্ষোভেও মূল দাবি ছিল সেটাই। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সামিল হয় স্কুলের পড়ুয়ারাও। মৃতের স্কুলের প্রধানশিক্ষক মহম্মদ খুরশেদ আলম বলেন, “অভাবের কারণেই একটু বেশি বয়সে ওই দুই পড়ুয়া এ বছর লোয়ার কেজিতে ভর্তি হয়েছিল। প্রতিদিন ওদের বাবা সাইকেলে দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়ে যেতেন। আবার ছুটির পর বাড়ি নিয়ে যেতেন। এমন ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। পড়ুয়াদের নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল।”
এ দিন সামশেরগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত মজুমদার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে যানজট কমাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওসি মাইকে ঘোষণা করেন, ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থার পাশাপাশি রাস্তার দু’পাশে যানবাহন দাঁড়ানো বন্ধ করা হবে। কড়া পদক্ষেপ করা হবে চোরাই কয়লা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও। তারপরেই অবরোধ উঠে যায়। যদিও দীর্ঘ এই অবরোধের ফলে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে পড়ে বহু গাড়ি। রোদে-গরমে নাকাল হন বহু মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা হল, আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাস্তার দু’পাশও মুক্ত হয়ে যাবে। প্রশাসন আগেই ব্যবস্থা নিলে এই দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত।
বিহ্বল বাবা মানারুল হক বলেন, “স্কুলে দিতে এসে শেষ পর্যন্ত ছেলের দেহ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে! বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেব বলুন তো?”