উদ্ধার করা হেরোইন। —নিজস্ব চিত্র।
হেরোইন পাচার করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল এক স্কুল ছাত্র। বুধবার সন্ধ্যায় লালগোলা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “বাংলাদেশে হেরোইন পাচার করতে গিয়ে ওই ছাত্র ধরা পড়েছে। তার কাছ থেকে এক কেজি হেরোইন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। হেরোইন পাচারে সে ‘কেরিয়ার’-এর কাজ করে। তার সঙ্গেই ধরা পড়ছে বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া আট রশিয়া গ্রামের হেরোইন ব্যবসায়ী ইসমাইল শেখ। তার কাছ থেকে ২ কেজি হেরোইন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।” পুলিশের মতে, বাজেয়াপ্ত ৩ কেজি হেরোইনের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।
হেরোইন পাচারের অভিযোগে লালগোলা থানা এলাকা থেকে এই নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে ৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশের মতে, ধরা পড়েনি অথচ হেরোইন পাচারের ‘ক্যারিয়ার’-এর কাজে যুক্ত রয়েছে সেই সংখ্যাটা আরও বেশি। সেই তালিকায় রয়েছে হতদরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের কলেজ পড়ুয়া তরুণও। হেরোইন পাচারের মতো নিষিদ্ধ ব্যবসায় পড়ুয়াদের ভিড় কেন? সেই কারণ ব্যাখার আগে লালগোলার হেরোইন ব্যবসার তিন দশকের নাতিদীর্ঘ ইতিহাস চকিতে ফিরে দেখা যাক।
মুর্শিদাবাদ জেলা গোয়েন্দা দফতর ও লালগোলার স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে সাড়া জাগানো তথ্য। তিন দশক আগের কথা। তখন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, এমনকী আফগানিস্তান থেকে নানান চোরা পথ ঘুরে হেরোইন পৌঁছত লালগোলায়। তারপর পদ্মা পার হয়ে হেরোইন চলে যেত বাংলাদেশ-সহ বিশ্ব বাজারে। সেই অবৈধ ব্যবসায় রাতারাতি লালগোলায় কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। বিশাল ইটভাটা, কাঠের মিল, হোটেল ব্যবসা, বহুজাতিক সংস্থার শোরুম, অথবা জমি সম্পত্তির মালিক হয়ে সেই কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া অব্যাহত।
জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, এমনকী আফগানিস্তান থেকে নানান চোরাপথ ঘুরে হেরোইন আমদানি করতে ঝুঁকি বেশি, সেই তুলনায় লাভ কম। ফলে কম ঝুঁকিতে অঢেল লাভের পথ আবিষ্কার করলেন দু’ দশক আগে স্থানীয় এক হাই স্কুলের শিক্ষক তথা তৎকলীন শাসক দলের এক গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। তিনি পদ্মার চরে পোস্তগাছের চাষ শুরু করেন। উত্তর প্রদেশ থেকে কারিগর নিয়ে এসে সেই পোস্ত ফল থেকে লালগোলাতেই হেরোইন তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন।” কয়েক বছরের মধ্যে লালগোলা জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো সেই কারখানা ও পোস্ত চাষ শুরু হয়ে যায়। পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের অশুভ আঁতাতে ডান-বাম নির্বিশেষ সেই ব্যবসায় মেতে ওঠে লালগোলার একটা বড় অংশ। রাজ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে হেরোইন ডনদেরও আনুগত্যের বদল ঘটে। ইতিমধ্যে লালগোলার প্রচলিত পুলিশি ব্যবস্থারও ব্যতিক্রমী পরিবর্তন ঘটে যায় বছর আড়াই আগে।
লালগোলা ব্লক তৃণমূলের নির্বাহী সভাপতি গৌর পাল, লালগোলা পঞ্চায়েত প্রধান কংগ্রেসের অজয় ঘোষ, স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী তথা হাই স্কুল শিক্ষক জাহাঙ্গির মিঞা ও স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অন্যতম কর্তা সারজেমান শেখেদের কথায়, “পুলিশের তৎপরতায় হেরোইনের কারবার আগের থেকে এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে।” পুলিশি পরিসংখ্যান বলছে, গত আড়াই বছরে হেরোইন পাচারের ৩৫০টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৪০০ জনেরও বেশি। বাজেয়াপ্ত হয়েছে কয়েক মণ হেরোইন ও হেরোইন তৈরির উপকরণ। আর এখানেই আছে হেরোইন কারবারের ‘ক্যারিয়ার’ হিসাবে পড়ুয়াদের জড়িয়ে পড়ার বাস্তব ভিত্তি।
বুধবার সন্ধায় লালগোলা থেকে বাজেয়াপ্ত করা উর্দু ভাষায় লেখা হেরোইনের প্যাকেট দেখেই বোঝা যায়, সে গুলি এসেছে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, অথবা মধ্যপ্রদেশ থেকে। এ কথা জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “হেরোইন পাচারের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট পয়েন্ট লালগোলায় এখন ওই নিষিদ্ধ ব্যবসা প্রায় বন্ধ। ফলে চোরাপথে কিছু হেরোইন আসছে অন্য রাজ্য থেকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ঝুঁকির কাজ করা পরিচিত ক্যারিয়ারদের পক্ষে খুবই কঠিন। ক্যারিয়ারের সেই কঠিন কাজকে সহজ করতে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মতো আনকোরা মুখ কাজে লাগানো হচ্ছে মোটা টাকার টোপ দিয়ে।” স্কুল শিক্ষক জাহাঙ্গির বলছেন, “কখনও দারিদ্র, কখনও কাঁচা টাকার লোভে সেই টোপ গিলছে বহু পড়ুয়াও। এটা উদ্বেগের। এই বিষয়ে প্রশাশন থেকে শুরু করে রাজনীতির কারবারি সকলকেই সচেতন হতে হবে। না হলে এর খেসারত দিতে হবে সকলকেই।”