বিরল মুদ্রা ও বিস্মৃত রাজার সন্ধান নতুন বইয়ে

বিস্মৃত এক রাজবংশের সন্ধান পেয়েছেন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ নোমান নাসির ও শঙ্করকুমার বসু। চট্টগ্রাম তাম্রশাসনে ভদ্রদত বা ভদ্রদত্ত, ধনদত্ত ও কান্তিদেব-এর নাম পাওয়া যায়। তাতে কান্তিদেব-এর জমি দান করার কথা রয়েছে।

Advertisement

অলখ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০৪:০১
Share:

রাজা কান্তিদত্তের রুপোর মুদ্রা। —নিজস্ব চিত্র।

বিস্মৃত এক রাজবংশের সন্ধান পেয়েছেন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ নোমান নাসির ও শঙ্করকুমার বসু।

Advertisement

চট্টগ্রাম তাম্রশাসনে ভদ্রদত বা ভদ্রদত্ত, ধনদত্ত ও কান্তিদেব-এর নাম পাওয়া যায়। তাতে কান্তিদেব-এর জমি দান করার কথা রয়েছে। হরিকেল বা এখনকার বাংলাদেশের কুমিল্লা-শ্রীহট্ট-চট্টগ্রাম এলাকার ভূস্বামীদের সেই তাম্রশাসনে কান্তিদেব-এর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বলা হয়েছে। তাম্রশাসনে কান্তি-র পরে ‘দত্ত’ কথাটি ছিল না। যা থেকে রমেশচন্দ্র মজুমদার অনুমান করেছিলেন, কান্তিদেব দত্ত বংশের নন, তিনি সম্ভবত মাতামহ ভদ্রদত্তর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব পেয়েছিলেন। বা নিজেই ওই ভূখণ্ডে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘কিন্তু এ বার তাঁর রুপোর মুদ্রার খোঁজ পেয়েছি আমরা। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে কান্তিদেব ওই বংশেরই রাজা। কোনও কারণে দত্ত উপাধি ত্যাগ করে নিজের নামের সঙ্গে তাম্রপত্রে দেব উপাধি যোগ করেছিলেন।’’ রুপোর মুদ্রায় তিনি নিজের নাম কান্তিদত্ত বলেই উল্লেখ করেছেন। রুপোর মুদ্রা প্রচলন করায় এ-ও বোঝা যায়, এঁরা শুধু ভূস্বামীই ছিলেন না, রীতিমতো প্রভাবশালী রাজা ছিলেন।

মোট তিনটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। ওজন যথাক্রমে ৭.২, ৫ ও ৭.১ গ্রাম। তিনটিরই ৩০ মিলিমিটার করে
ব্যাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সুচন্দ্রা ঘোষ বলেন, ‘‘এই মুদ্রা খুঁজে পাওয়ায় কান্তিদেব ও কান্তিদত্ত যে একই ব্যক্তি তা বোঝা গেল। এটি একটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।’’ হরিকেল থেকে দশম শতকের অত্তাকর দেব একজন রাজার কথাও জানা যায়। তাঁর নামেও রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।

Advertisement

মুদ্রার উপরে প্রাকৃত ব্রাহ্মীতে লেখা কান্তিদত্তর নাম। অক্ষরবিন্যাস অনুযায়ী এটি নবম শতকের। তখন বাংলায় রাজত্ব করতেন পালেরা। কিন্তু পালেদের রাজত্বের সে সময়ে পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের উপরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। হরিকেল এলাকায় তখন একাধিক ভূস্বামী প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ভদ্রদত্ত সম্ভবত তাঁদেরই একজন ছিলেন। এত দিন পর্যন্ত কেবল একটি তাম্রশাসনেই তাঁদের অস্তিত্বের পরিচয় ছিল। এ বার তাঁদের মুদ্রাও পাওয়া গেল। সে কথা শঙ্করবাবু ও নোমান নাসির আলোচনা করেছেন তাঁদের প্রকাশিতব্য বই ‘আর্লি কয়েনেজ অফ বেঙ্গল’-এ।

শুধু তাই নয়। বইটিতে রয়েছে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত নানা মুদ্রার বিবরণ ও ছবি। আজ বুধবার দি এশিয়াটিক সোসাইটিতে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করবেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘এই বইটি প্রাক ত্রয়োদশ শতকের বাংলার মুদ্রা সম্ভারের একটি সামগ্রিক পরিচয়। নিম্ন গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে উত্তর বাংলা, দক্ষিণ পূর্ব বাংলা ও দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার এ যাবৎকাল প্রাপ্ত মুদ্রার সম্ভারের একটি বিশ্লেষণের প্রয়াস।’’

বইটিতে এক সঙ্গে এই বারোশো বছরের মুদ্রাগুলির নানা ছবিও পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গেই রয়েছে অনেক অজানা কথাও। যেমন, দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে পাওয়া একটি রুপোর মুদ্রার কথাও রয়েছে, যেখানে প্রাকৃত ব্রাহ্মীতে ‘লীলাবরাহ’ লেখা রয়েছে, রয়েছে বরাহের একটি ছবিও। যা থেকে বোঝা যায়, নবম শতকেই ওই এলাকায় বৈষ্ণবদের প্রভাব ছিল। এই মুদ্রাটি সম্পর্কে সম্প্রতি শঙ্করবাবু ও মিলাপ নাখাটের রচনা প্রকাশিত হয়েছে ইংল্যান্ডের দি ওরিয়েন্টাল নিউমিসম্যাটিক সোসাইটির জার্নালে।

ওই সোসাইটিরই সদস্য নোমাননাসির থাকেন ঢাকায়। দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সম্মানপ্রাপ্ত শঙ্করবাবুর বাড়ি অসমের ধুবুরিতে। তাঁদের বইটির ভূমিকা লিখেছেন সুচন্দ্রাদেবীই। তাঁর কথায়, ‘‘এই বইটিতে অনেক বিরল মুদ্রার ছবি থাকায় অনেকেই উপকৃত হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন