কার উদ্দেশে মন্ত্রীর ‘বোমা’ নিক্ষেপ, জল্পনা তা নিয়েই

স্রেফ নাট্যকার বা নির্দেশক ব্রাত্য বসু নন। মন্ত্রী বা শাসক দলের নেতা ব্রাত্য বসুর দিকেও ধেয়ে আসছে প্রশ্নটা। তাঁর নতুন নাটক ‘বোমা’য় কাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে বোমাটা, এই জল্পনা এখন নাট্যজগতের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গিয়েছে। নাটকে আপাত ভাবে ১০০ বছর আগের গল্প বলেছেন ব্রাত্য। যখন সাহেব তাড়াতে বিদেশে তালিম নিয়ে বোমা বাঁধতে শিখেছিল বাঙালি।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০৩:২১
Share:

‘বোমা’ নাটকের একটি দৃশ্যে দেবশঙ্কর হালদার এবং পৌলমী বসু। — নিজস্ব চিত্র।

স্রেফ নাট্যকার বা নির্দেশক ব্রাত্য বসু নন। মন্ত্রী বা শাসক দলের নেতা ব্রাত্য বসুর দিকেও ধেয়ে আসছে প্রশ্নটা।

Advertisement

তাঁর নতুন নাটক ‘বোমা’য় কাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে বোমাটা, এই জল্পনা এখন নাট্যজগতের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গিয়েছে।

নাটকে আপাত ভাবে ১০০ বছর আগের গল্প বলেছেন ব্রাত্য। যখন সাহেব তাড়াতে বিদেশে তালিম নিয়ে বোমা বাঁধতে শিখেছিল বাঙালি। কিন্তু নাটক দেখতে দেখতে সে-ইতিহাস যেন উহ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে তোলা দর্শকদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, অরবিন্দ, বারীন ঘোষ বা হেমচন্দ্র কানুনগোরা এখনকার রক্তমাংসের চরিত্র। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দ্বিধাদ্বন্দ্বের চোরাস্রোতে নাট্যকার যেন আজকের রাজনীতির অস্থির সময়ের কথা বলছেন।

Advertisement

ব্রাত্য নিজে অবশ্য তা মানতে নারাজ। ‘‘এ কোনও নির্দিষ্ট কালখণ্ড নয়। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের যে কোনও সময়ের ছাপই ‘বোমা’য় থাকতে পারে।’’ ২০১৫-র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমালোচনা অস্বীকার করে তৃণমূলের মন্ত্রীর বরং দাবি, ‘‘আমি তো মনে করি, পরিবর্তনের পরে রাজ্যের অবস্থা সব দিক দিয়েই ভাল হয়েছে।’’

রাজনীতিতে ব্রাত্যর সতীর্থ, তৃণমূল সাংসদ তথা ইতিহাসবিদ সুগত বসু কিন্তু সমকালের সঙ্গে ব্রাত্যর নাটকের মিলটুকু অস্বীকার করছেন না। তবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাতি সুগতবাবুর মতে, ‘বোমা’য় ইতিহাসকে কাঠামোর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে নির্দিষ্ট কোনও একটি যুগ নয়, অনেকগুলো সময়ের স্বর মিশেছে। ‘‘আবার তার মানে আমাদের আজকের রাজনৈতিক যুগের সঙ্গে ‘বোমা’র যোগাযোগ নেই, এটাও বলা যায় না।’’

অধুনা নানা বিষয়ে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ, কবি শ্রীজাতও বোমা’য় বেশ আচ্ছন্ন। বলছেন, ‘‘শেষ ১০-১৫ মিনিটে তো নাটকটা একেবারে আমাদের এ যুগের আয়না হয়ে ওঠে।’’ নাটকের শেষ দৃশ্যে ঋষি অরবিন্দ তাঁর রাজনীতি থেকে সরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। রাজনীতির জগতে দেখা অবিশ্বাস, সন্দেহ, ‘মধ্যমেধার বাগাড়ম্বর’ বা চটজলদি ফলের লোভে তিনি বীতশ্রদ্ধ। ব্রাত্যর বারীন ঘোষও স্পষ্টতই এ কালের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ছাঁচে গড়া। মনে করেন, ‘অবিশ্বাসই নেতৃত্বের ধর্ম’! এবং ‘নিজের ছায়া’কেও বিশ্বাস করেন না।

সমকালের রাজনীতির সঙ্গে মিলটুকু নাটকটি ইতিমধ্যে দেখে ফেলা শাসক দলের কোনও কোনও নেতাকে একটু অস্বস্তিতেও রেখেছে। অধুনা দলের নেতৃত্বের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিরোধের সূত্রে খবরের শিরোনামে আসা তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় কিছুতেই ‘বোমা’য় এ যুগের রাজনৈতিক জগতের ছায়া পড়ার কথা স্বীকার করবেন না। ‘‘আমার তা মনে হচ্ছে না! সশস্ত্র বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে মূল স্রোতের রাজনীতির কী মিল থাকবে?’’ সৌগতবাবু অন্য ভাবে ‘বোমা’র ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর মতে, অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এর ঢঙে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সমালোচনাই ব্রাত্যর নাটকের প্রধান উপজীব্য। তিনি বলছেন, ‘‘কয়েকটি চরিত্রের সঙ্গে বরং নকশাল আন্দোলনের সময়কার অতিবাম সংগঠনের নেতাদের আদল মিলতে পারে।’’

এ দেশের জঙ্গি বাম আন্দোলনের ভেতরকার মত ও পথের সংঘাত নিয়ে বিতর্ক যে তীব্র ভাবে ‘বোমা’য় ঢুকেছে তাতে দ্বিমত নেই সুগতবাবুরও। তবে ব্রাত্যর ‘বোমা’-র অভিঘাতে তিনি বলছেন, ‘‘আমরা যারা অন্য জগত্ থেকে রাজনীতিতে এসেছি, তারাও নিজেদের প্রশ্ন করি, কী চাই আর কী করতে পারছি! স্বাধীনতাসংগ্রামীদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেও নিজেদের অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকি!’’ রাজ্যের বিরোধী-শিবিরের মধ্যেও ‘বোমা’ নিয়ে জল্পনা চলছে। সিপিএমের সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরা অনেকেই নাটকটি দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন।

তবে ব্রাত্যর নাটকে যে এই প্রথম সমকালের রাজনীতির ছাপ পড়ল, এমন নয়। এক যুগ আগের ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এ ব্রাত্য সরাসরি বাংলায় বাম আমলের স্বপ্নভঙ্গের কথা বলেছেন। আর ২০০৯-এ ‘রুদ্ধসঙ্গীতে’র সময়ে সংস্কৃতি-জগতে প্রাতিষ্ঠানিক বামেদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঘনিয়ে উঠেছে। ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, প্রমোদ দাশগুপ্তদের মধ্যে উঠে আসে সৃজনশীলতা বনাম সাংগঠনিক অনুশাসনের সংঘাত। কিন্তু ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ বা ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর সময়ে ব্রাত্যর সঙ্গে সরাসরি রাজনীতির যোগ ছিল না। ‘বোমা’র মঞ্চায়নের সময়ে নির্দেশক-নাট্যকার-অভিনেতা ব্রাত্য শাসক দলের মন্ত্রীও বটে! মন্ত্রী ব্রাত্য আগের কয়েকটি নাটকের প্লটে বরং রাজনীতির জগতকে খানিক এড়িয়ে চলেছেন। ‘বোমা’য় এসে সেটাই ফের প্রকট। কারওর কারওর বরং মনে হচ্ছে, মন্ত্রী বা নেতা ব্রাত্য নিজেও নাটকের চরিত্রে মিশে গিয়েছেন।

রাজনীতির জগতে ঢুকে পড়ে ‘প্রতিমার পিছনে খড়ের চালাটা দেখে ফেলা’র কথা উঠে এসেছে একটি চরিত্রের সংলাপে। বারবার বলা হয়েছে, রাজনীতির নেতাদের বাইরে থেকে মহিমময় দেখতে লাগে। কাছে গেলে সেটাই মিথ্যের ফানুস ওড়ানো বলে মনে হয়। প্রশ্ন উঠছে, নাট্যকার কি নিজের কথাই বলছেন?

ব্রাত্যর নিজের দাবি, ‘‘আমি থাকলে সব চরিত্রের মধ্যেই আছি! আবার কারও মধ্যেই নেই।’’ তবে নাট্যকার ব্রাত্য, রাজনীতিবিদ ব্রাত্য বা মন্ত্রী ব্রাত্যর ভেতরের সংঘাতটাও একেবারে অস্বীকার করছেন না। বাম আমলের শেষ দিক থেকে এখনও পর্যন্ত ব্রাত্যর রাজনৈতিক জীবনেও নানা ওঠা-নামার ছায়া পড়েছে। কয়েক মাস আগে শিক্ষামন্ত্রী থেকে তাঁকে পর্যটনমন্ত্রীর ভূমিকায় সরানো নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনার জন্ম হয়েছিল।

‘‘বোমাটা আমি মারলাম না খেলাম, তা তো দর্শক বুঝবেন,’’ সহাস্যে বলছেন নাট্যকার। ‘‘নানা পরস্পরবিরোধী সত্তাকে বুঝতে, এবং যুঝতে যুঝতেই ‘বোমা’য় একটা সমে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছি।’’

রাজনীতি বা রাজনীতির বাইরের লোকের কাছে নেতা-মন্ত্রী তথা শিল্পীর এই তাগিদটুকুই ‘বোমা’র প্রধান মশলা হয়ে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন