ডাক্তারদের বিভ্রান্তির একশেষ। রোগীদের দুর্ভোগও চরমে।
কারও চোখের পাতা স্থির। শরীরের এক-একটা দিক অসাড় হয়ে পড়ছে, ঠিক যেমন পক্ষাঘাতে হয়। ডাক্তার ভাবছেন, সেরিব্রাল অ্যাটাক। অথচ সিটি স্ক্যান বলছে, মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়নি। মানে, সেরিব্রাল নয়!
কেউ যখন কূল-কিনারা পাচ্ছেন না, তখন হয়তো রোগীর চোখের পাতা নড়ছে। শরীরের অবশ অংশে সাড়ও ফিরছে। ততক্ষণে অবশ্য বেশ ক’ঘণ্টা স্যালাইন চালানো হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা কী?
পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, এ হল গিয়ে ডেঙ্গি-জীবাণুর নতুন এক মাহাত্ম্য। হেমারেজিক ডেঙ্গিতে কখনও-কখনও স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে ঠিকই। কিন্তু হেমারেজিক ধরা পড়ার আগেই ডেঙ্গিরোগী পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে যাচ্ছে, এমন ঘটনা চার দশকের ডাক্তারি জীবনে তিনি দেখেননি বলে জানাচ্ছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তার কথায়, ‘দিন দিন হরেক ধরনের ডেঙ্গি পেশেন্ট পাচ্ছি। হরেক উপসর্গ দেখছি। সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনাও করছি।’’ তবু ডেঙ্গি ভাইরাস কেন সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করছে, তার জবাব এখনও পাননি প্রবীণ ওই গবেষক-চিকিৎসক।
সকলের অভিজ্ঞতা যদিও এক নয়। ট্রপিক্যালের আর এক প্রাক্তন অধিকর্তা তথা পতঙ্গবিদ অমিয়কুমার হাটি যেমন হেমারেজিক ডেঙ্গি ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে এই জাতীয় উপসর্গ পাননি। ‘‘স্নায়ুতন্ত্রের উপরে এমন আঘাতকে হেমারেজিক শক সিন্ড্রোম বলা যেতে পারে।’’— মন্তব্য অমিয়বাবুর। আবার মেডিসিনের চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের দাবি, ‘‘গত ক’মাসে যত ডেঙ্গিরোগী দেখেছি, কারও ক্ষেত্রে স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়নি।’’
এক ভুক্তভোগীও জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। সদ্য ডেঙ্গি থেকে সেরে ওঠা মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলছেন, ‘‘মাথা এমন ঘুরছিল যে, চক্কর খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ কোনও সাড় ছিল না। পরে উঠলাম বটে, কিন্তু নিজের নামটাও মনে করতে পারছিলাম না। বাড়ির লোকের মুখে শুনেছি, তখন আমি ভুলভাল বকছিলাম!’’
ডাক্তারবাবু ওঁকে জানিয়েছেন, রক্তে ডেঙ্গি-জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটেছিল। শুনে রোগী থ। ‘‘কী আশ্চর্য! ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি। ডেঙ্গির এমন উপসর্গের হদিস কোথাও পাইনি।’’— প্রতিক্রিয়া তাঁর।
কারণটা কী? বিশেষজ্ঞেরা অনেকে আঙুল তুলছেন জীবাণুর জিন-চরিত্র বদলের দিকে। তাঁদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরজীবীরা যে ভাবে নিজেদের পাল্টে ফেলছে, তাতে ডেঙ্গি-ভাইরাসের এ হেন ভেল্কিবাজি অসম্ভব কিছু নয়। এক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের গবেষকের কথায়, ‘‘বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ও মানবদেহের অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার তাগিদে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার জিনের গঠন হামেশা পাল্টাতে থাকে। একটা সময়ে নতুন ধরনের জীবাণুর প্রজন্ম গজিয়ে ওঠে, যাদের সহজে বাগে আনা যায় না।’’
আর তারাই অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিবায়োটিককে এড়িয়ে কোষের মধ্যে ঢুকে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। আইসিএমআর-সূত্রের খবর: রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর গত সব ক’টি সম্মেলনের চূড়ান্ত রিপোর্টের সুপারিশ— জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রোগ-জীবাণুর জিনগত পরিবর্তনের দিকটা মাথায় রেখেই যেন স্বাস্থ্য-নীতি তৈরি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো পতঙ্গবাহিত সংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়বে তো বটেই, সেগুলো আরও জটিল হযে উঠবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আইপিসিসি।
বস্তুত উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস ও কলকাতা-দিল্লিতে সাম্প্রতিক ডেঙ্গি সংক্রমণের পিছনে এরই ছায়া দেখছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ওঁদের বক্তব্য: সাধারণত সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে ডেঙ্গির দাপট বাড়ে। শীত যত এগিয়ে আসে, ভাইরাস তত দুর্বল হয়ে পড়ে। এ বারও তা-ই হবে ভেবে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও কলকাতা পুরসভা নিশ্চিন্ত ছিল। সে আশায় জল পড়েছে। বৃষ্টির পালা শেষ হয়ে তাপমাত্রা একটু একটু করে নামতে থাকা সত্ত্বেও রোগের দাপট তুঙ্গে!
ভবানীপুরের এক ডাক্তারের চেম্বারে তারই ছবি। রোগীর লাইন বাইরে চলে এসেছে। অনেকের জ্বর-সর্দিকাশির সঙ্গে চোখ-মাথায় বেদম যন্ত্রণা। ডাক্তারবাবু জানালেন, এ মাসের শেষে তাঁর বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। অবস্থা দেখে সব বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। চিকিৎসকদের আশা, ডিসেম্বরের মাঝ নাগাদ শীত জাঁকিয়ে বসলে কিছুটা সুরাহা হবে।
এখন পরিত্রাণের উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, মশা দূর করা অসম্ভব। উপরন্তু ডেঙ্গির ভ্যাকসিনও নেই। তাই লড়াইয়ের হাতিয়ার সাকুল্যে দু’টো। এক, মশার কামড় এড়াতে হবে, যার জন্য মশারি ব্যবহার জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশে ডেঙ্গি-ভাইরাসের উপস্থিতিতে রাশ টানার স্বার্থে দ্রুত রোগ নির্ণয় হওয়া চাই। ‘‘আইজিজি, আইজিএম টেস্টের জন্য সাত দিন বসে থাকলে বিপদ। সত্যি ডেঙ্গি হয়ে থাকলে সাত দিনে রোগীর দেহ থেকে মশা মারফত জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে।’’— বলছেন এক বিশেষজ্ঞ। তাই ওঁদের দাওয়াই— প্রথমেই প্রাথমিক জীবাণু পরীক্ষা করান। রিপোর্ট পজিটিভ এলে রোগীকে মশারির মধ্যে রাখুন।
এতে অন্তত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমবে।