রামনাথের ঐতিহ্যেই প্রাণ পাচ্ছে নবদ্বীপের বঙ্গ বিবুধ জননী সভা

‘নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’ গ্রন্থে পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ বলেছেন, নবদ্বীপ কে সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় নগর বলা হত। অবশ্য তখন নবদ্বীপ বলতে শুধু আজকের নবদ্বীপ শহরটুকুই নয়, উপকণ্ঠে অবস্থিত বিদ্যানগর এবং চারপাশের গ্রামগুলিকেও বোঝাতো।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬ ০১:২১
Share:

রামনাথের জন্মভিটে। নবদ্বীপে তোলা নিজস্ব চিত্র।

‘নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’ গ্রন্থে পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ বলেছেন, নবদ্বীপ কে সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় নগর বলা হত। অবশ্য তখন নবদ্বীপ বলতে শুধু আজকের নবদ্বীপ শহরটুকুই নয়, উপকণ্ঠে অবস্থিত বিদ্যানগর এবং চারপাশের গ্রামগুলিকেও বোঝাতো। বেলপুকুর, বিল্বগ্রাম, শান্তিপুর, পূর্বস্থলী, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, অম্বিকা কালনা, গুপ্তিপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নবদ্বীপ কেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চা। এই বিরাট এলাকা জুড়ে তখন অসংখ্য চতুষ্পাঠী ছিল।

Advertisement

কিন্তু সেই সুখের সময় বারবার বাধার মুখে পড়ে। তুর্কি আক্রমণের পরে নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার গৌরব ফিরে এসেছিল। কিন্তু তা আবার ম্লান হতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ শাসন পর্বের শুরু থেকেই। বিদেশি শাসকের আনুকূল্য পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে সংস্কৃতকে বাঁচাতে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ ১৮৮৬ সালে এক শিক্ষাসংসদ তৈরি করেন। দেশের প্রাচীনতম সেই শিক্ষাসংসদই নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই শিক্ষা সংসদ গড়ে ওঠে আপোষহীন কিংবদন্তী বুনো রামনাথের ভিটেতে। বিদেশি শাসকের বিরোধিতার মুখে সংস্কৃত চর্চাকে দাপটের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল সেকালের বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। বিদেশি শাসক গিয়েছে বহুকাল। সংস্কৃতের দুঃখ ঘোচেনি। সে আজ “মৃত ভাষা”। বেশ কিছুদিন যাবত বঙ্গ বিবুধ জননী সভা নতুন উদ্যমে সংস্কৃত চর্চায় নবদ্বীপে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৮৮৬ সালে পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহকে সভাপতি এবং অবসর প্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করে দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের এক সঙ্গে নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে একটা সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই সভা স্থাপন করা হয়েছিল।

তবে তা গৌরবময় অতীত। বুনো রামনাথের ভিটের ওপর ৩৮ কাঠা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে বেআইনি ভাবে। এখন অবশিষ্ট আছে ১৫ কাঠা জমি। আছে এক মূল্যবান গ্রন্থাগার আর পোড়োবাড়ির চেহারা নেওয়া ভবন। একশ তিরিশ বছরের ভাষা চর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস বুকে নিয়ে নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার সুদিন ফিরিয়ে আনতে ফের উদ্যোগী হয়েছে বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ এবং শিক্ষানুরাগী একদল মানুষের আন্তরিক উদ্যোগে বছর দুয়েক ধরে সভায় চলছে নানা কর্মকান্ড।

Advertisement

সভার নিজস্ব ভবনে অর্থাৎ বুনো রামনাথের ভিটেয় অনুষ্ঠিত হয় সংস্কৃত ও প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন। সারা রাজ্যের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা জড়ো হয়েছিলেন দু দিনের এই সম্মেলনে। সেই সম্মেলন থেকে রাজ্যের বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থীরা দাবি তোলেন বুনো রামনাথের ওই জন্মভিটায় রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। এবিষয়ে ওই সম্মেলন থেকে সকলের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।

বঙ্গ বিবুধ জননী সভার সম্পাদক নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃতের অবসর প্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অরুন কুমার চক্রবর্তী বলেন, “নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ধারাটি নতুন করে গতি পাক এটাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বুনো রামনাথের জন্মভিটায় গড়া হবে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র। সেখানে সংস্কৃত চর্চার পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা, আয়ুর্বেদ চর্চা, শাস্ত্রচর্চা সবই হতে পারে প্রাচ্যবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমরা আবেদন করেছি। আপাতত একেবারে থেমে যাওয়া এই শিক্ষা সংসদকে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ফের সক্রিয় করে তোলা গিয়েছে।” তাঁর কথায় রাজ্য সরকার নবদ্বীপে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য এক সদস্যের ‘নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি কমিটি’ গড়েছেন। তাঁরাও বিষয়টি দেখছেন। বঙ্গ বিবুধ জননীসভা মনে করে বুনো রামনাথের ভিটেয় সংস্কৃত মহা বিদ্যালয় গড়া হলে নিঃসন্দেহে নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার পুনরুজ্জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। সভার মুখ্য উপদেষ্টা তথা নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা অন্য কাজের সঙ্গে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস সংরক্ষণের কাজে। নবদ্বীপের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃত গ্রন্থ প্রকাশ, বঙ্গ বিবুধ জননী সভার বন্ধ হয়ে যাওয়া মুখপত্রের দ্বিভাষিক পুনঃপ্রকাশের পাশাপাশি একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হছে। যাতে বিদেশি গবেষকেরা পুনরায় নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চায় যুক্ত হতে পারেন। সেই সঙ্গে অর্থ সংগ্রহের কাজও চলছে।”

বঙ্গ বিবুধ জননী সভার দীর্ঘদিনের সভাপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলে ছিলেন এই সংস্থার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি বাটি হাতে পথে নামতেও রাজী। তাঁর সেই কথাকে সম্বল করে মৃত ভাষার প্রান প্রতিষ্ঠার অসম লড়াইয়ে নেমেছেন বঙ্গ বিবুধ জননী সভার সদস্যরা।

কবে সে আবার ফিনিক্স পাখির মতো বেঁচে ওঠে তারই অপেক্ষায় নবদ্বীপের সারস্বত সমাজ।

(শেষ)

(গতকাল বুনো রামনাথের যে ছবিটি ছাপা হয়েছে সেটি কাল্পনিক। ছবিটি এঁকেছেন অলোক ভট্টাচার্য)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন