গবেষণায় চুরি-কারচুপি রুখতে প্রযুক্তি, শাস্তিও

পিএইচডি স্তরের গবেষকদের জন্য কড়াকড়ির ব্যবস্থা থাকলেও সব সময় সেটা তেমন কঠোর ভাবে প্রয়োগ হয় না। গবেষণায় টোকাটুকি ঠেকাতে এ বার শুধু পিএইচডি নয়, এমফিল এবং স্নাতকোত্তর স্তরেও প্রযুক্তিকে কার্যকর দায়িত্ব দিতে চাইছে ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

Advertisement

মধুরিমা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০৩:০৩
Share:

পিএইচডি স্তরের গবেষকদের জন্য কড়াকড়ির ব্যবস্থা থাকলেও সব সময় সেটা তেমন কঠোর ভাবে প্রয়োগ হয় না। গবেষণায় টোকাটুকি ঠেকাতে এ বার শুধু পিএইচডি নয়, এমফিল এবং স্নাতকোত্তর স্তরেও প্রযুক্তিকে কার্যকর দায়িত্ব দিতে চাইছে ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা হচ্ছে শাস্তিরও। শাস্তি মানে জরিমানা থেকে ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া পর্যন্ত সব কিছুই হতে পারে।

Advertisement

গবেষণাপত্রে টোকাটুকি রুখতে বছর চারেক আগেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল ইউজিসি। এ বার রীতিমতো আইন জারি করতে চাইছে তারা। আইন না-মানলে যথোচিত শাস্তির বিধান রাখারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শুধু পিএইচডি-র গবেষণাপত্র নয়, স্নাতকোত্তরের ডিসার্টেশন, যা সাধারণত শেষ সেমেস্টারে জমা দিতে হয় পড়ুয়াদের, তাতেও এই নিয়মবিধি বলবত্ হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ‘প্লেজিয়ারিজম’ বা অন্য গবেষণাপত্র থেকে টুকে লেখা রুখতে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে ইউজিসি। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে খুব তাড়াতাড়ি সেই প্রস্তাব পাঠাবে তারা। যাতে চলতি বছরের মধ্যেই এই বিষয়ে বিল পাশ করানো যায়।

Advertisement

এখন গবেষণায় টোকাটুকি ঠেকাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নেয়। এই সংক্রান্ত বিল পাশ হলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অভিন্ন নিয়ম চালু হবে। পিএইচডি-র গবেষণায় টোকাটুকির মোকাবিলায় ইউজিসি জানিয়েছিল, অবিলম্বে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অ্যান্টিপ্লেজিয়ারিজম সফ্‌টওয়্যার’-এর ব্যবহার শুরু করতে হবে। গবেষণাপত্রের একটি ই-কপি দিতে হবে ইউজিসি-র ইনফর্মেশন অ্যান্ড লাইব্রেরি নেটওয়ার্ক সেন্টার (ইনফ্লিবনেট)-কে। ইউজিসি একটি অ্যান্টিপ্লেজিয়ারিজম সফ্‌টওয়্যারের নাম প্রস্তাব করেছিল আগেই।

এ ক্ষেত্রে সফ্‌টওয়্যার প্রযুক্তি ঠিক কী ভাবে কাজ করে?

নিয়ম অনুযায়ী পূর্বপ্রকাশিত গবেষণাপত্রের থেকে কোনও অংশ ব্যবহার করতে গেলে সেই গবেষক এবং তাঁর গবেষণাপত্রের নাম উল্লেখ করার কথা। কেউ সেটা না-করে অন্যের গবেষণাপত্রের কোনও অংশ ব্যবহার করলেই চুরি করে লেখার দায়ে পড়বেন। কোনও গবেষণাপত্রে কোটেশন বা উদ্ধৃতি চিহ্ন-সহ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই কোনও অংশ (কমপক্ষে টানা ৩০ শব্দের কোনও অনুচ্ছেদ বা বাক্য) পাওয়া গেলে এই ধরনের সফ্‌টওয়্যার তা ধরে ফেলে। এত দিন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম ছিল শুধু পিএইচডি-র গবেষকদের ক্ষেত্রেই। কিন্তু প্রস্তাবিত খসড়া নীতি অনুযায়ী আর শুধু পিএইচডি থিসিস নয়, এমফিলের গবেষণামূলক প্রবন্ধে এবং স্নাতকোত্তরের প্রজেক্ট রিপোর্টেও প্রযুক্তির চোখ দিয়ে নজরদারি চালাবে ইউজিসি।

গবেষণা বা প্রজেক্ট তৈরির ক্ষেত্রে পড়ুয়া-গবেষকেরা আগেকার বিভিন্ন গবেষণাপত্রকে ব্যবহার করেই থাকেন। কিন্তু নিয়ম হল, সেই সব গবেষণাপত্র থেকে কোনও বক্তব্য বা পরিসংখ্যান নিজের গবেষণাপত্রে ব্যবহার করতে হলে সূত্র উল্লেখ করে সেই গবেষকের ঋণ স্বীকার করতে হয়। যথেষ্ট পরিমাণে সূত্র উল্লেখ না-করলে তা অপরাধ বলেই ধরা হয়। এই অপরাধে শাস্তিরও বিধান দিয়েছে ইউজিসি। গবেষণাপত্রে টোকাটুকির মাত্রা কম হলে প্রথমে জরিমানা নিয়ে সচেতন করেই গবেষককে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু টোকাটুকির মাত্রা বেড়ে গেলে তাঁকে সেই গবেষণাপত্র বা প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিতেই দেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ তাঁর রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত বাতিল করে দিতে পারেন। অপরাধের মাত্রা চরম হলে এমনকী পড়ুয়া-গবেষকের ডিগ্রিও কেড়ে নেওয়া হতে পারে।

নিয়মবিধি যে সম্পূর্ণ নতুন, তা নয়। কিন্তু সেটা আছে খাতায়-কলমেই। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক-অধ্যাপকই যথাযথ ভাবে যাচাই না-করে গবেষণাপত্র অনুমোদন করে দিয়েছেন। অনেক দেশে এই অপরাধে শাস্তি হিসেবে পড়ুয়া-গবেষকের ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া, বরখাস্ত করাব মতো কার্যকর ব্যবস্থা আছে। এ দেশে গবেষণায় চুরি নিয়ে এই প্রথম এমন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ শুরু হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডিন আশুতোষ ঘোষ জানান, এখানেও এই ধরনের শাস্তির সংস্থান রয়েছে। তবে কার্যক্ষেত্রে সেগুলো কতটা প্রয়োগ করা হয়, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ‘‘ইউজিসি স্নাতকোত্তর স্তর থেকেই এই শাস্তির ব্যবস্থা চাইছে এবং অবশ্যই সেটা দরকার। আমরাও চাই, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিধি ও ব্যবস্থা আরও ব্যাপক ভাবে চালু হোক,’’ বলেছেন আশুতোষবাবু।

গবেষণায় চুরি ধরতে দীর্ঘদিন ধরেই সফ্‌টওয়্যার-প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘যে-সব বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইনফ্লিবনেট’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, তারা এই সফ্‌টওয়্যার ব্যবহার করতে পারে। আমরা গবেষণায় টোকাটুকি রুখতে ষথেষ্ট নজর রাখি।’’ যাদবপুরের ইতিহাসে গবেষণায় টোকাটুকির কোনও নজির নেই বলেই উপাচার্যের দাবি।

অ্যান্টিপ্লেজিয়ারিজম সফ্‌টওয়্যার আছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েও। ওই প্রতিষ্ঠান সূত্রের খবর, কোনও থিসিস জমা পড়লেই তার সফ্‌ট কপি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দফতরে। সেখানেই থিসিসটি যাচাই করে নেওয়া হয়। তবে এই সফ্‌টওয়্যারের উপরেও সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছেন না সেখানকার উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার। ‘‘যন্ত্র সব সময় ঠিক হয় না। তাই গবেষণায় টোকাটুকি রুখতে এই বিষয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করছেন, তাঁদের সাহায্য প্রয়োজন,’’ বললেন উপাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন