এনআইএ অফিসারদের সঙ্গে বিক্রম খালাটে। নিজস্ব চিত্র
খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিন গোষ্ঠীর সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ ছিলই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ)-র প্রাথমিক তদন্তের পরে সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। এনআইএ-র ধারণা, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের দুই জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদত দিচ্ছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এবং এই কারণেই এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি বিস্ফোরণ-কাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল হাকিমের নিরাপত্তা আরও আঁটোসাঁটো করার কথা বলেছে এনআইএ।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, রবিবার মঙ্গলকোটের একটি মাদ্রাসায় রাতভর তল্লাশি চালিয়ে তারা বেশ কিছু পুস্তিকা এবং অন্যান্য নথি উদ্ধার করেছে। তার পর প্রায় সারা রাত ধরে সেই সব নথি পরীক্ষা করে দেখেছেন সংস্থার নিজস্ব ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল-সহ ধৃত তিন সন্দেহভাজনের মোবাইলের কল লিস্টও পরীক্ষা করে দেখেছেন তাঁরা। এনআইএ-র এক কর্তা জানান, ওই সব মোবাইল, বিশেষত শাকিলের মোবাইল থেকে নিয়মিত দুবাইয়ে ফোন করা এবং সেখান থেকে ফোন আসার প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে মনে করা হচ্ছে, ঘটনার সঙ্গে জামাতের সরাসরি যোগ থাকলেও এর পিছনে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন এবং আইএসআইয়ের পরোক্ষ মদত রয়েছে।
সংবাদসংস্থার খবর, এই সূত্রে এনআইএ-র তদন্তে উঠে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার নামও। এ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় জঙ্গি মডিউল গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানে শাসক দলের ওই নেতা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছেন বলে প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ এনআইএ কর্তাদের।
গত ২ অক্টোবর ওই বিস্ফোণের ঘটনায় মারা গিয়েছে দু’জন। এক জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সে আব্দুল হাকিম। বাকি দুই মহিলা-সহ তিন জন ছিল সিআইডি-র হেফাজতে। তদন্তের স্বার্থে ধৃতদের মধ্যে তিন জনকে (হাকিম হাসপাতালে থাকায় তার জন্য আবেদন জানানো যায়নি) নিজেদের হেফাজতে নিতে সোমবার কলকাতা নগর দায়রা আদালতে আবেদন জানিয়েছিল এনআইএ। বিচারক তিন জনকেই ২২ অক্টোবর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক ভাবে গত বৃহস্পতিবার রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তদন্তের দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। গত দু’দিন ধরে বিধাননগরে সিআরপিএফ-এর তিন নম্বর ব্যাটেলিয়ন চত্বরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পুরোদস্তুর অফিস এবং লক-আপ তৈরি করে ফেলেছে এনআইএ। বিস্ফোরণে জড়িত সন্দেহে ধৃত তিন জন হাশেম মোল্লা, আলিমা বিবি এবং রাজিয়া বিবিকে এ দিনই হেফাজতে পেয়েছে এনআইএ। সংস্থার এক কর্তা জানান, রাজ্য সরকারের আওতাধীন কোনও জায়গায় রেখে ধৃত তিন জনকে জেরার কথা প্রাথমিক ভাবে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তের শুরুতেই আইএম এবং আইএসআই যোগসূত্র পাওয়ায় কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাই এ দিন আদালত থেকে ধৃতদের নিজেদের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের আশা, ধৃত তিন জনকে জেরা করে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।
তদন্তে উঠে এসেছে, বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলিতেও জামাত জঙ্গিরা ‘মডিউল’ তৈরি করেছে। এনআইএ-র দাবি, খাগড়াগড় কাণ্ডের পরে বেশ কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যে ভাবে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলার প্রমাণ মিলেছে, তাতে আইএসআইয়ের ছায়া দেখছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশের জামাতের সঙ্গে আইএসআই-এর সম্পর্ক সুবিদিত। এখন দেখা যাচ্ছে আইএম-এর সঙ্গেও আইএসআই-এর যোগাযোগ রয়েছে। প্রধানত ভারত-বাংলাদেশ এবং ভারত-নেপাল সীমান্তে এই দুই গোষ্ঠীর সাহায্যেই শক্তি বাড়াচ্ছে আইএসআই। এনআইএ-এর কলকাতা শাখার পুলিশ সুপার বিক্রম খালাটে এ দিন বলেছেন, “আমরা সব দিক খোলা রেখেই তদন্ত করছি। কারণ, এখন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে।”
এ দিন সিআইডি-র হাতে থাকা তিন জনকে নিজেদের হেফাজতে নিতে আদালতের দ্বারস্থ হয় এনআইএ। চিকিৎসাধীন আব্দুল হাকিমের নিরাপত্তা নিয়ে বিচারকের সামনেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন এনআইএ-এর আইনজীবী। নগর দায়রা আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারক গোপালচন্দ্র কর্মকার এ দিন কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ) এবং এসএসকেএম হাসপাতালের সুপারকে হাকিমের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। সুপারকে বলা হয়েছে, চিকিৎসক-নার্স-তদন্তকারীরা ছাড়া আর কেউ যেন হাকিমের কাছে না যেতে পারে।
এর আগে এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ আলিমা, রাজিয়া এবং হাশেমকে আদালতে হাজির করায় সিআইডি। আলিমা এবং রাজিয়া আদালতে পৌঁছয় তাদের দুই শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে। বেলা দু’টো নাগাদ এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ তিন অভিযুক্তকে ১৪ দিনের জন্য তাদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানান। বিচারককে তিনি জানান, বর্ধমানের খাগড়াগড়ে যে বিস্ফোরণ হয়েছে, তার ব্যাপকতা আন্তর্জাতিক। এনআইএ-র সন্দেহ, ষড়যন্ত্রের আরও গুরুত্বপূর্ণ নথি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলি বাজেয়াপ্ত করার জন্যও ধৃতদের হেফাজতে নেওয়ার দরকার।
এ দিন অভিযুক্তদের পক্ষে কোনও আইনজীবী আদালতে দাঁড়াননি। ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারক একতরফা সওয়াল শুনেই তিন অভিযুক্তকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এনআইএ-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।