হলদিয়া থেকে শালবনি প্রায় ১৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে কনিষ্ঠতম পদযাত্রী ছিলেন সৈকত জানা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র সৈকতের সঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। শুক্রবার শালবনিতে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।
ঘরপোড়া গরু ‘সিঙ্গুরে মেঘ’ দেখলে ডরায়! আগুন লাগার আগেই তাই দমকলের ব্যবস্থা সেরে ফেললেন সূর্যকান্ত মিশ্র!
রাজ্যে শিল্পের দাবিতে বামেদের ১৯২ কিলোমিটারের দীর্ঘ পদযাত্রা শুক্রবার শেষ হল শালবনিতে। শিল্পের দাবিতে এমন পথ পরিক্রমা এ রাজ্যে যেমন বিরল, তেমনই চলার পথে সাড়াও মিলেছে বিপুল। কিন্তু শিল্পায়নের দাবিতে বামেরা ফের রাস্তায় নেমেছে মানে ক্ষমতায় ফিরলে তারা জমি কেড়ে নেবে— হাল্কা সুরে হলেও বিধানসভা ভোটের আগে সেই প্রচারে শান দিতে শুরু করেছিল তৃণমূল। আশঙ্কা আঁচ করেই
পদযাত্রার শেষে শালবনির সমাবেশ থেকে বার্তা দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক। সিঙ্গুর-পর্বের ভুল খোলাখুলি মেনে নিয়ে তাঁর ঘোষণা, শিল্পের জন্য জমি লাগবেই। কিন্তু বামেরা ক্ষমতায় ফিরলে এ বার আর বহু-ফসলি জমি বা বসত বাড়ির জমিতে হাত পড়বে না।
ভয় উপেক্ষা করে, দোকানপাট বন্ধ রেখেও ভিড়-জমানো জনতার সামনে সূর্যবাবু এ দিন ঘোষণা করেছেন, বাম সরকার ফিরলে সিঙ্গুরে কারখানার মতোই শালবনিতেও জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্প ফিরিয়ে আনা হবে তাঁদের অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গেই সূর্যবাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘আমরা বলছি না, আগে সব ঠিক ছিল। বোঝাবুঝির ভুল ছিল। আমরা ভুল করেছি। কে আছে ইতিহাসে, যে ভুল করেনি? ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগোতে হয়। ভুল করেছি, এটা স্বীকার করার সাহসও আমাদের আছে!’’
কী ভুল? জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতিগত ভুলের কথাই বলেছেন সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য। শিল্পায়নের লক্ষ্য ঠিক থাকলেও তার রূপায়ণের পথে যে ভুল হয়েছিল, সে কথা ইতিমধ্যে সিপিএমের নানা দলিলেও মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে এতটা খোলাখুলি সেই ক্রটি স্বীকার করে নেওয়া সাম্প্রতিক কালে সিপিএমের কোনও প্রথম সারির নেতার মুখে শোনা যায়নি। সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘জমি সংবেদনশীল ব্যাপার। জমির উপরে মানুষের আলাদা টান থাকে, জমি চলে গেলে মানুষ বিচলিত হয়ে পড়েন। শিল্পের জন্য আমরা যে জমি নেব, তার জন্য মানুষের বাসের জমি বা বহু ফসলের জমিতে হাত দিতে চাই না।’’
বস্তুত, সিঙ্গুরের বিতর্ক ছিল টাটার ছোট গাড়ির প্রকল্পের জন্য বহু-ফসলি জমি অধিগ্রহণ করার প্রশ্নেই। বিরোধী নেত্রী হিসাবে জমি আন্দোলনের পূর্ণ ফায়দা তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুরে শেষ পর্যন্ত কারাখানা হয়নি, মমতার সরকার এসে জমিও মালিকদের ফেরত দিতে পারেনি। আইনি জটে আটকে হতাশ ‘অনিচ্ছুক’ জমি মালিকেরাও এখন বলছেন, সে দিন বাম সরকার এত তাড়াহুড়ো না করলে তাঁরা হয়তো জমি দিয়েই দিতেন! এই প্রেক্ষাপটেই শিল্পের জন্য পদযাত্রার সূচনা করতে সিঙ্গুরে গিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘আবার সরকার হলে ওই পথেই যাব!’’ তাতে এক দিকে যেমন ‘অনিচ্ছুক’দের অভিমানে প্রলেপ পড়েনি, তেমনই বাম শিবিরের মধ্যেও অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। শালবনিতে এ দিন ক্ষিতি গোস্বামী, প্রবোধ পণ্ডা, হাফিজ আলম সৈরানি, নটবর বাগদীদের মঞ্চে বসিয়েই ত্রুটি সংশোধনের বার্তা দিয়েছেন সূর্যবাবু। এক বাম নেতার কথায়, ‘‘শিল্প তো করতেই হবে। কিন্তু মানুষের ভরসা পেতে আগে আমাদের ভুল কবুল করে এগোনোই ভাল। ঠিক সেই কাজটাই সূর্যবাবু করেছেন।’’
সতর্ক হয়ে জমি নেওয়ার লক্ষ্যের পাশাপাশিই সূর্যবাবু জানিয়েছেন, ভূমি-ব্যাঙ্কে থাকা জমিও তাঁরা ক্ষমতায় এলে শিল্পের কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। যদিও সেখানে এক লপ্তে অনেকটা জমি পাওয়া দুষ্কর, শিল্পের পরিকাঠামোও দুর্বল। সেই সূত্রেই সূর্যবাবুর
কটাক্ষ, যে সরকার (মমতার) জমিই নেয় না, তাদের আবার ভূমি-ব্যাঙ্ক হয় কী করে? ‘ল্যান্ডব্যাঙ্ক’ নামটা অবশ্য বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া বলে মন্তব্য করে বিরোধী দলনেতার দাবি, সেখানে বেশির ভাগ জমিই বাম আমলে নেওয়া। যা শিল্পের কাজে লাগেনি।
সূর্যবাবুর এই দাবি খণ্ডন করে রাজ্যের শিল্প দফতর সূত্রে অবশ্য পাল্টা বলা হয়েছে, ভূমি-ব্যাঙ্কের ভাবনা এই আমলেই বাস্তবায়িত হয়েছে। ওই সূত্রের দাবি, বিভিন্ন শিল্প-পার্কে পাঁচ হাজার একর জমি আছে। বিভিন্ন দফতরের হাতে-থাকা ১ লক্ষ একর জমিও চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই রকম জমিতেই হরিণঘাটা, বজবজ, ডোমজুড় এবং হলদিয়া শিল্প-পার্ক তৈরি হয়েছে। গত চার বছরে ১৫টি তথ্য-প্রযুক্তি পার্ক, ৬টা ‘থিম সিটি’ গড়ে উঠেছে। আর রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্য, ‘‘৩৪ বছরে ওঁরা রাজ্যের শিল্পায়ন করতে পারেননি। তার দায় ওঁদেরই নিতে হবে। এখন কাজ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
শিল্প ও বণিক মহলে অবশ্য হাল্কা স্বস্তি— শাসক-বিরোধীর মধ্যে এখন ‘কেজো’ তরজা চলছে! লড়াইয়ের কেন্দ্রে ফিরে এসেছে শিল্প।