মাদার টেরিজার ‘অলৌকিক মহিমা’য় সুস্থ হওয়া মনিকার জীবনে ভ্যাটিকান নেই

ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে দশ জনের সংসার। সম্বল বলতে ছ’বিঘা জমি। আরও চার বিঘা ছিল অবশ্য। দক্ষিণ দিনাজপুরের নাকোড় গ্রামের মনিকা বেসরার যখন অসুখ করেছিল, সেই চার বিঘা বন্ধক রাখা হয়েছিল। চোদ্দো বছর কেটে গিয়েছে। জমি আর ছাড়ানো যায়নি।

Advertisement

অনুপরতন মোহান্ত

হরিরামপুর শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৬ ০৪:০৬
Share:

২০০৪। ভ্যাটিকানে মনিকা।

ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে দশ জনের সংসার। সম্বল বলতে ছ’বিঘা জমি। আরও চার বিঘা ছিল অবশ্য। দক্ষিণ দিনাজপুরের নাকোড় গ্রামের মনিকা বেসরার যখন অসুখ করেছিল, সেই চার বিঘা বন্ধক রাখা হয়েছিল। চোদ্দো বছর কেটে গিয়েছে। জমি আর ছাড়ানো যায়নি।

Advertisement

সেই মনিকা বেসরা। মাদার টেরিজার ‘অলৌকিক মহিমা’য় যাঁর পেটের টিউমার মিলিয়ে গিয়েছিল বলে দাবি। সেই ‘মহিমা’র জোরেই মাদার টেরিজাকে সন্ত ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন কলকাতার মাদার হাউস থেকে খোদ ভ্যাটিকান— সকলের কাছেই রাতারাতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন মনিকা। মাদারের বিয়েটিফিকেশন, মানে তাঁকে সন্ত পদে উন্নীত করার প্রথম ধাপে, মনিকাকে ভ্যাটিকানেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সে সব যেন আজ অন্য জীবনের গল্প। মনিকা এখন জমিতে কাজ করেন, প্রয়োজনে অন্যের জমিতেও মজুরি খাটেন। রোজ ভোরে উঠে কখনও ডোবা পুকুরে পাট ধুতে হয়। কোনও দিন নিড়ানি দেন ধানের জমিতে। গত শুক্রবার মাদারের জন্মদিনটিও আর আলাদা করে মনে রাখা হয়নি মনিকার। সে দিনও তিনি দূরের জমিতে মজুর খাটতে চলে গিয়েছিলেন। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর মাদারকে সন্ত ঘোষণা করার কথা ভ্যাটিকানের। সে খবর মনিকা শুনেছেন। তবে মাদার হাউসের সঙ্গে তাঁর আর তেমন যোগাযোগ নেই।

Advertisement

চোদ্দো বছর আগে মনিকাই কিন্তু শিরোনামে ছিলেন। পেটে একটি টি‌উমার হয়েছিল। চিকিৎসাও হচ্ছিল বালুরঘাট হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকের দাবি ছিল, তাঁদের ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়েছেন মনিকা। কিন্তু মনিকা নিজে দাবি করেছিলেন, স্থানীয় চার্চের এক সিস্টারের কথা শুনে একদিন মাদারের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি একটি ক্রস পেটের উপরে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। উঠে দেখেন, টিউমার মিলিয়ে গিয়েছে। মনিকার সেই কথার ভিত্তিতেই মাদারের ‘অলৌকিক মহিমা’র কাহিনি প্রচার পায়।

২০১৬। কাজ করছেন মাঠে।ছবি: অমিত মোহান্ত

২০০৪ সালে মাদারের বিয়েটিফিকেশনের সময় মনিকাকে ভ্যাটিকানে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জন পল স্বয়ং মনিকার সঙ্গে দেখা করেন। সেই ছবি সযত্নে আজও ঘরে রেখেছেন তিনি। সে বার প্রায় এক মাস ভ্যাটিক্যানে ছিলেন মনিকা। মনিকার স্বামী সেলকু মুর্মু জানান, তার পরপরই তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেওয়ার নির্দেশ এসেছিল কলকাতার মাদার হাউস থেকে। সেই মোতাবেক স্থানীয় চার্চের সিস্টাররা রাজীবপুর মিশন স্কুলের হস্টেলে রেখে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির পর যখন বাড়ির খরচে পড়াশোনা চালানোর সময় এল, মনিকারা টানতে পারেননি।

অভাবের সংসারে বড় ছেলে গোপীনাথ বা মেজ ছেলে ড্যানিয়েল মুর্মুর পড়াশোনা আর হয়নি। এখন তাদের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে লরেন্স মুর্মুর পড়াও বেশি দূর এগোয়নি। মেয়ে সালোনি মু্র্মু একাদশ শ্রেণির পরে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। বাবা-মার সঙ্গে হাত মিলিয়েই সবাই খেতে কাজ করে। সেজ ছেলে বার্নাবাস মুর্মু কেবল দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।

মনিকা বলেন, ‘‘শুনেছি মাদারকে সন্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে আমার টিউমার সেরে যাওয়ার ঘটনাটির গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু মাদারের কলকাতার আশ্রম বা অন্য কেউ আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি।’’ এর মধ্যে আনন্দবাজারের তরফে মাদার হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। তাঁরা ই-মেল করতে বলেছিলেন। রবিবারই ই-মেল করা হয়। রাত পর্যন্ত উত্তর আসেনি।

আজও দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে মাদারের ছবিতে রোজ প্রণাম করেন মনিকা। কিন্তু মাদার হাউস বা ভ্যাটিকান সিটির স্মৃতি তাঁর কাছে আবছা হয়ে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন